Your slogan here
Welcome
Here you can
enter your
own text


commercial cleaning broward
আসরের নামাজের পরেই মুকবুলের কব্জি হতে হাত দু’টি কেটে ফেলা হবে।উৎসুক মানুষ তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে!একটি নিম গাছের সাথে তাঁকে বেঁধে রাখা হয়েছে।আসরের নামাজের আর বেশী দেরী নেই। নামাজের শেষেই আসবে বিচারক মন্ডলী,রায় প্রদানকারী আজব আলি মতাব্বর.......!তারপরেই মুকবুলের কব্জি হতে হাত দু’টি কেটে ফেলা হবে! মানুষের কিছু কিছু ঘটনা আছে,যা সরল রেখার মত চলে;আবার কিছু কিছু ঘটনা আছে ,যা বক্র রেখার মত চলে।আবার কিছু ঘটনা আছে সুতাই গিট বাঁধার মত;শত চেষ্টাতেও গিট খোলা যায় না।মুকবুলের জীবন প্রবাহটা ঠিক সুতাই গিট বাঁধার মত। মুকবুলের স্ত্রী, মেয়ের জন্ম দিয়েই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল।আত্মীয় বলতে শুধু মেয়েই রইল।সে কবে ফরিদপুর ছেড়ে রাজশাহী এসেছে পেটের তাগিদে, আর ফিরে যাইনি।অনাত্মীয়রা কিছু কিছু আত্মীয় হয়েছে বটে;কিন্তু আত্মীয় অনাত্মীয়র পার্থক্যটা সে ভালোভাবেই অনুভব করে। তবুও জীবন চলেছে,কখনই সরল রেখায় নয়;বক্র রেখাই।যদিওবা কোনো মানুষের জীবনই সরল রেখাই চলে না,তবুও ত কখনও কখনও কোনো কোনো মানুষের জীবনে সরলতা আসে,সরলভাবে চলে?কিন্তু মুকবুলের জীবন কখনই সরলভাবে চলেনি। মুকবুল মূর্খ মানুষ!কোন বিষয় নিয়ে গভীর ভাবে ভাবতে হয়,এ বোধ তার কখনই ছিল না।মেয়ের বয়স যখন তের;মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিল।তের বছর বয়সে যে,একটা মেয়ের বিয়ে দেওয়া ঠিক কাজ নয়;এ জ্ঞান তার মধ্যে কখনই ছিল না। মেয়ের বিয়ে দিয়ে,মুকবুল যত না খুশী হয়েছিল,তার চেয়ে বেশী কষ্ট পেয়েছিল।একাকীত্ব জীবন নিয়েই তাঁর পথ চলা,সে পথে,তাঁর স্ত্রী এসে সঙ্গ দিয়েছে,কিছু সময়ের জন্য,রেখে গেছে মেয়েকে।বাবাকে মায়ের স্নেহ দেবার জন্য।সেই মা,তাঁর মেয়ে হাসুর জীবনও যে সুতাই গিট বাধার মত হবে,কুৎসিত কালো মেঘের ন্যায় প্রবাহিত হবে,মুকবুল তা কখনই ভাবেনি। মুকবুল মেয়ের বিয়ে দেবার পর হতেই,তাঁর জীবনে নেমে এল এক অশনি সংকেত।বিয়ের কিছু দিন পর হতেই তাঁর মেয়ের ওপর শুরু হল অত্যাচার।যৌতুক নামক কুলষিত অস্বীকৃতি এক নিয়ম হাসুর কাঁধে ভর করল।হাসু জানে,কোনরুপ অর্থ দেবার ক্ষমতা, তাঁর বাবার নেই।তের বছরের হাসু নিরুপায়!তবুও সে তাঁর বাবার কাছে,তাঁর দাম্পত্য অত্যাচারের কথা,অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলতে বাধ্য হল। মুকবুল একজন ভ্যান গাড়ি চালক।বয়সভারে ভ্যান চালাতে তাঁর কষ্ট হয়।তবুও ক্ষুধা নামক পেট যন্ত্রণার তাগিদে,তাঁকে ভ্যান চালাতেই হয়। ভ্যান চালিয়ে যা পাই,তিন বেলা না হলেও দু’বেলা তাঁর খাবার জুটে।কিন্তু মেয়ের বিয়ে দেবার পর হতে,সেটাও তাঁর ভাগ্য হতে সরে গেল।ভাগ্যের পরিহাস!মেয়ে হাসুর জন্য এমন কোনো স্থানীয় N.G.O নেই যে,সেখান হতে ঋণ নিতে বাকী রইল না তাঁর।অবশেষে,N.G.O কিস্তি তাঁর গলাই এমনভাবে বাঁধল যে, খাদ্য নামক বস্তুটি আর তার পেট পর্যন্ত পৌঁছাল না।ক্ষুধা তার নিত্য দিনের সঙ্গী হয়ে গেল।তবুও সে মেয়ে হাসুর মুখে হাসি দেখতে চায়। হাসু মা হল।তাও আবার মেয়ের।বাঙ্গালি সমাজে,প্রথম “মা”, এটা একটা আনন্দের বিষয়।কিন্তু হাসুর জীবনে নেমে এল,আগুনে পোড়া কাঠ-কয়লার মত জীবন।হাসুর বাবার আর কিছুই নেই যে, তাঁর জামাই মফিজকে কিছু দেবে।বিধায় হাসুর ওপর মফিজের অত্যাচারের পরিমানটাও বৃদ্ধি পেল। একদিন সন্ধ্যার একটু আগে,হাসু তাঁর বাবার ঘরে এল।বাবা মুকবুল উঠোনে এটা খুঁটিতে হেলনা দিয়ে বসেছিল।হাসুকে দেখে,তাঁর অন্তরের মধ্যস্থল শূণ্য হয়ে গেল,ধক করে আওয়াজ করে ওঠল তাঁর হৃপিন্ড!হাসুর চেহারার দিকে তাকাবার তাঁর সাহস হল না।সে মাথা নিচু করে নিল। বাবা। হাসু ডাকল।মুকবুল আস্তে আস্তে তাঁর মাথা তোলে হাসুর দিকে তাকাল।বলল, মা,দে,তোর মেয়েটা আমার কাছে দে।হাসু তাঁর মেয়েকে,তাঁর বাবার কাছে দিল।তাঁর দু’চোখ দিয়ে নদীর ধারার ন্যায় পানি গড়িয়ে পড়তে থাকল। ওরা তোকে তাড়িয়ে দিয়েছে,তাই নারে?হাসুর মুখ থেকে কোন কথা বের হল না। আমি জানি,ওরা তোকে তাড়িয়ে দিয়েছে.....আমি কী করব বল?তোর বাবা যে অক্ষম,তোকে দেবার মত,আমার যে আর কিছু নেই মা। হাসু হো-হো করে কেঁদে ওঠল;কিন্তু তাঁর কাঁন্নায় কোন তীব্রতা নেই।মুখ থেকে কথা বের করবে, এ ক্ষমতাও যেন তাঁর নেই।খুব ক্ষীণ স্বরে বলল,বাবা,তুমি আমাকে রাখবে না?তুমিও কী.....!মুকবুল কোন কথা বলল না।মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁন্নায় ভেঙ্গে পড়ল।বেশ কিছু সময় পার হয়ে গেল বাবা-মেয়ের এই দুঃখ-কষ্টের সন্ধিক্ষণ।তারপর বাবা মুখ খুলল- তোর খুব ক্ষুধা পেয়েছে,তাই নারে? যাঁর জন্ম ক্ষুধা নিয়ে, তাঁর কী কখনও ক্ষুধা লাগে বাবা?ক্ষুধা ত আমাদের পথের সঙ্গী,জীবনের সাথী...... আমি জানি,আমি জানি,তোর পেটে বড় ক্ষুধা!ক্ষুধার যন্ত্রণায় তুই কাতর।কিন্তু আমার ঘরে ত পানি ছাড়া কিছই নেই মা।যা মা,তোর মেয়েকে নিয়ে ঘরে যা,ওরও হয় ত ক্ষুধা পেয়েছে..... বাবা-মেয়ের সাথে আর কোন কথা হল না।হাসু তার মেয়েকে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। রাত দ্বিপ্রহর।তন্দ্রাচ্ছন্ন মুকবুল খুঁটিতে হেলান দিয়ে আছে। হাসুর মেয়ের কাঁন্নার চিৎকারে,মুকবুলের তন্দ্রাচ্ছন্ন কেটে গেল।মেয়েটা এত কাঁদছে কেন? তাঁর মনের মধ্যে প্রশ্ন হল।সে আস্তে আস্তে ওঠে দাঁড়াল।ঘরের মধ্যে ঢুকে দিয়াশলাই খোঁজার চেষ্টা করল।তাঁর দিয়াশলাই খোঁজার শব্দ পেয়ে হাসু বলল,কে,বাবা? হ্যাঁ মা।তোর মেয়েটা এত কাঁদছে কেন?বোধ হয় ক্ষুধা পেয়েছে.....একটু দুধ দে না। যাঁর পেটে দু’দিন পানি ছাড়া কিছুই পড়েনি তেমন,তাঁর বুকে দুধ আসবে কোথায় থেকে বাবা! মুকবুলের মুখ হতে কোনো কথা বের হল না।সে দিয়াশলাই খোঁজার চেষ্টা করতে লাগল।দিয়াশলাই পেয়েও গেল।বাতি জ্বালাল।বাতির আলোতে হাসুর মুখ দেখে সে চমকে গেল।সে মনে মনে বলতে লাগল এমন অর্থব বাবা যেন,পৃথিবীতে আর দু’টি না হয়। মা,মারে,তুই আর একটু কষ্ট কর,আমি তোর আর তোর মেয়ের জন্য যেমন করে হউক খাবার যোগাড় করে নিয়ে আসছি। এত রাতে তুমি কোথায় খাবার পাবে বাবা?তাছাড়া,তুমি আমার জন্য আর কত কষ্ট করবে? এই রাতে যদি তোর আর তোর মেয়ের জন্য খাবার আনতে পারি,এ ত আমার কষ্ট নয়রে মা,এ আমার সুখ! মুকবুল আর কথা বাড়াল না।সে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।কোথায় খাবার পাবে,সে চিন্তা তাঁর মাথায় নেই;সে শুধু জানে,যেমন করে হউক,তাকে খাবার যোগাড় করতেই হবে।মুকবুল হাঁটছে,ভাবছে,হঠাৎ তাঁর মাথায় এল, মতাব্বরের গোয়ালে গেলেই হয়।সেখানে অনেক গরু।একটু দুধ নিয়ে এল মতাব্বরের তেমন কিছু হবে না।কিন্তু হাসু আর হাসুর মেয়ে কষ্ট থেকে বেঁচে যাবে।সে দেরী করল না। মুকবুল ভাবতেই পারেনি, মতাব্বরের গোয়ালে একটু দুধ নিতে এসে ধরা পড়ে যাবে।দুধ চোর নয়;গরু চোর হিসাবে তাঁকে চিহ্নিত করা হবে।মুকবুল সবাইকে তাঁর অবস্থাটা বোঝানোর চেষ্টা করল অনেক;কিন্তু কেউ তাঁর কথা বুঝল না। রাতের শেষ প্রহরে মুকবুল ধরা পড়ল।তখন হতেই শুরু হল তার ওপর শারিরীক অত্যাচার।শারিরীকভাবে ত নয়ই;মানুষিকভাবেও এ অত্যাচার ধারণ করার ক্ষমতা মুকবুলের ছিল না।সে জ্ঞান শূণ্য হয়ে পড়ল।সে চারপাশ অন্ধকার দেখল।তাঁর মনে হল, ক্ষুধার্থ হায়েনার দল, লোভাতুর দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছে।আকাশ ঘিরে রয়েছে শকুনিরা।তাঁর মুখে কথা নেই;ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে....... নজু আজব আলি মতাব্বরের সেনাপতি নামে খ্যাত।সে ই মুকবুলের হাত দু’টি কবিজ হতে কেটে ফেলবে।সে কুঠারে ধার দিচ্ছে আর মাঝে মঝে কুৎসিত দৃষ্টিতে মুকবুলের দিকে তাকাচ্ছে।নজুকে দেখলেই মনে হয়,তার মনের মধ্যে জঘন্য এক আনন্দের স্রোত বইছে।সে মাঝে মাঝেই বলছে,অনেক দিন রক্ত দেখি নাই.....অনেক দিন রক্ত দেখি নাই।এরুপ কথা শুনে মুকবুলের মধ্যে কোনো রুপ অনুভূতি জাগ্রত হচ্ছে বলে মনে হয় না।তাঁর মস্তিস্ক যখনই একটু সজাগ হচ্ছে,তখনই শুধু হাসু আর হাসুর মেয়ের কথা মনে পড়ছে।কব্জি হতে যে তাঁর হাত দু’টো কেটে ফেলবে,সে ভয় কখনই তাঁর বোধ হল না। আসরের নামাজ আদায় করে বিচারক মন্ডলী,আজব আলি মতাব্বর ও মুসল্লিরা এল।মসজিদের ইমাম সাহেবও রয়েছেন।ইমাম সাহেব মুকবুলের দিকে এগিয়ে গেল।রক্ত লোভাতুর নজুর মুখে শব্দহীন ভয়ংকর হাসি।একবার মুকবুলের দিকে তাকাই,একবার কুঠারের দিকে তাকাই। ইমাম সাহেব মুকবুলের কাছে গিয়ে বসল।মুকবুলের মাথায় হাত দিয়ে বলল,মুকবুল,আমি জানি, তুমি একজন ভালো মানুষ।অর্থ কষ্টে প্রায়শই ক্ষুধার যন্ত্রণায় ভুগো।তবুও তুমি কোনোদিন কারও কাছে কখনও হাত পাতনি;কারও কিছু কখনও চুরি করনি।আমি বিশ্বাস করি, মতাব্বরের গোয়ালে তুমি গরু চুরি করতে আসনি।কিন্তু আমি বুঝে উঠতে পারছি না, মতাব্বরের গোয়ালে কেন গিয়েছিলে?যায় হউক,আমার অনুরোধে তোমাকে এ যাত্রা ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে।তুমি আর এমন কাজ করবে না,এ অনুরোধটা রেখ।....নজুমিয়া,মুকবুলকে এবার ছেড়ে দাও। এমন কথা শুনে নজুর মন ভার হয়ে গেল।সে মতাব্বরের দিকে তাকাল। মতাব্বর,নজুকে ইশারা করে বলল,মুকবুলকে ছেড়ে দিতে। মতাব্বরের এহেন আচরণ দেখে মনে হয়;তারও ইচ্ছে নেই।ইমাম সাহেবের অনুরোধে, মুসল্লি সকল একমত পোষন করাই,আজব আলি বাধ্য হয়েছে। নজু মুকবুলের হাত দু’টি খুলে দিতে দিতে বলল,তোর ভাগ্যটা ভালো।আমার জনমে আমি কখনই এমনটি দেখিনি.....যা,যা চলে যা....... মুকবুলের ওঠে দাঁড়াবার মত শক্তি নেই;কিন্তু যখন তাঁর চোখের সামনে হাসুর মুখটা ভেসে ওঠল,কোথা হতে যেন শক্তি এসে গেল তাঁর দেহে।মুকবুল ওঠে দাঁড়াল।চারদিক সে তাকিয়ে দেখল।হাজারও চোখ যেন তাঁকে ঘৃণাভরে দেখছে।সে দিকে তাঁর দৃষ্টি নেই;তাঁর বারবার মনে হতে লাগল,হাসু আর হাসুর মেয়ের জন্য সে এখনও কিছু জোগাড় করতে পারেনি।তাঁকে যে ভাবেই হউক,কিছু খাবার তাঁকে নিয়ে যেতে হবে। মুকবুল কোনো কথা বলল না,কারও দিকে তাকালও না।সে সোজা হাঁটতে শুরু করল।তাঁর মনের মধ্যে নানান প্রশ্নের জন্ম নিল।কেন সে,এ বয়সে তাঁর মেয়ের বিয়ে দিল?বিয়ে না দিলে ত,তাঁকে N.G.O ঋণ নিতে হত না। N.G.O ঋণ না নিলে ত,তাঁর এত অভাব দেখা দিত না।ভ্যান চালিয়ে যা’ আয় হত,তাতে ত, বাবা-মেয়ে দু বেলা খেত পেত?সব কিছুর জন্য সে নিজেকে দায়ী করতে লাগল। মুকবুল ভাবতে ভাবতে কখন যে,সে তাঁর বাড়ি পৌঁছে গেছে,সে বুঝতেই পারেনি।উঠোনে ওঠতে গিয়ে মুকবুল থমকে গেল।তাঁর গা টা কেমন ছম-ছম করে ওঠল।ভেতোরে কোনো সাড়া-শব্দ নেই কেন?নিজেকেই সে প্রশ্ন করল।বুকের ভেতোরটা তাঁর ধক করে ওঠল।তবুও সে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। ঘরে ঢুকেই তাঁর চোখ দু’টো বন্ধ হয়ে গেল।তাঁর দেহ মন অসাড় হয়ে গেল।ঘুনে ধরা কাঠ বা পোকা লাগা জীবন্ত গাছ,হঠাৎ করে যে ভাবে পড়ে যায়;মুকবুলের দেহটা ঠিক সে ভাবেই মটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।সে এমন দৃশ্য দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না।তাঁর অসাড় দেহে শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করল।চোখ দু’টো খুলার চেষ্টা করল।কিন্তু কোনো ভাবেই সে চোখ দু’টো খুলতে পারল না। শাড়ির ফাঁসে হাসুর ঝুলন্ত লাশ!নিচে তাঁর মেয়ে প্রাণহীন এক জড় পদার্থ...বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রয়েছে,সে যেন এ সমাজকে ধিক্কার দিচ্ছে............. আমার কাছে মানুষের মন একটি ছিমছাম ঘরের মত । সে ঘর পূর্ণ থাকে রকমারি ভালবাসায় । একটুও ফাঁকা নেই , নেই শুন্যতা । ঘরের উপরের দিকে সম্ভবত পাটাতনে থাকে কোরান-হাদীস , বেদ , বাইবেল যা কিছু আমরা শ্রদ্ধা করি । চেয়ার-টেবিল , আয়না-চিরুনি , খাট-পালঙ্ক ঘরের প্রতিটি বৃত্তান্তে সাজানো ভালোবাসা , শুধুই ভালোবাসা । সেগুলো দেখতেও বড় বিচিত্র , মোটেও সাধারণ আসবাব পত্রের মত নয় । দেয়ালে ক্যালেন্ডার , তাতে শুধু প্রিয় দিনগুলো শোভা পাচ্ছে । আয়নাটা কারো চোখের মত , নিজেকে দেখতে বড় বিশ্বস্ত সেখানে । মায়ের আঁচলটি যেন খাট হয়ে জুড়ে আছে ঘরের প্রাঙ্গন। তবে মজার কথা হোল এই ঘর এমনকি ঘরের ভেতরের সব কিছু শুধু আপনি নিজেই দেখেন । খাট দেখেনা জানালা-দরোজা । দেয়াল জানেনা আলমারির খোঁজ , অথচ আলমারিটি তার গায়েই ঠেশ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । দৈবাৎ এরা যদি একে অন্যকে দেখে ফেলে , ফলাফল যে ঠোকাঠুকি হবেনা কে জানে ? যারা ভাল লাগার গণ্ডী পেরিয়ে এখনো ভালোবাসার রাজ্যে ঢুকতে পারেননি , তারা এলে আমরা বারান্দায় পাটি বিছিয়ে দেই । এক বাটি মুড়ি-পাটালী সামনে রেখে মাথার উপর তাল পাখাটা দোলাতে থাকি কিন্তু হুট হাট ঘরে টেনে তুলিনা । আজ আমার সে ঘরটি আপনাদের জন্য খুলে দেবার আগে বস্তুজগতে কয়েকটি মুখের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব । এই সাজ সকালে খুব ব্যস্ততা আমার স্ত্রী রেহানার । এখন সে ছাদে লেপ শুকোতে দিচ্ছে । তার মতে শীতের সকালে সবকিছু তাজা রোদে ফেলা স্বাস্থবিধিতে খুবই জরুরী । একে একে ঘরের লেপ-কম্বল-চাঁদরগুলো টেনে টেনে সে রোদে মেলবে । নিত্যকার রুটিন , সাতাশ বছর ধরে দেখে আসছি । একধরনের বাতিক আর কি । রৌদ্র বাতিক । তার ধারনা এখনো ঘুমোচ্ছি আমি । গায়ের কম্বলটির জন্য সে আরও কিছুক্ষন অপেক্ষা করবে । এক সময়ে কাপ পিরিচের ঠোকাঠুকিতে চোখ মেলতেই চায়ের কাপ হাতে ধরিয়ে দিয়ে কম্বলটা টেনে নিয়ে নিমিষে চলে যাবে ছাদে । কাপ হাতে পেছন থেকে হৈ হৈ করতে থাকবো আমি । আমাদের মেয়ে টিউলিপ , খুব সকালে ভার্সিটি গেছে । আজ বিকেলে তার বান্ধবীর গায়ে হলুদ। অনুষ্ঠান হবে শেরাটনে । ছেলেপক্ষ বিরাট বড়লোক । বিয়ে উপলক্ষে কনের বান্ধবীদের একটি করে দামী শাড়ী দেয়া হয়েছে পাত্র পক্ষ থেকে । এলাহী কাণ্ড । সব মিলে যুক্তি পরামর্শ করে ফেলেছে কে কিভাবে সাজবে , কি করবে । আজ তার প্লান ছিল ক্লাস মিস দিয়ে বিউটি পার্লারে যাবার । রাতে মায়ের কাছে টাকা চেয়ে সুবিধে করতে পারেনি । খুব সকালে নাস্তা না করেই ফোলা ফোলা চোখে ভার্সিটির পথ ধরেছে সে । আমার মেয়েরও একটা বাতিক আছে । প্রেম বাতিক । খুব ছোট বেলা থেকে সে প্রেমে পড়ে আসছে । তখন ক্লাস ওয়ানে । হঠাৎ এক বিকেলে দেখি মেয়েটি মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে । কাছে ডাকতেই অকপটে স্বীকার করলো , সিরাজ মামাকে সে বিয়ে করতে চায় । তাকে ছাড়া কিছুতেই বাঁচবে না । সিরাজ হোল পাশের বাড়ীর সমবয়সী রনির ছোট মামা । এস এস চি পাস করে বোন-দুলাভাইয়ের সংসারে উঠেছে । দুবছর ধরে তার কাজের রুটিন একই রকম , সকালে শর্ট হ্যান্ড এন্ড টাইপিং শেখা আর বিকেলে ওদের গল্প শোনানো । তিনদিন আগে তার চাকুরী হয়েছে , অফিস সেক্রেটারি । কালই যাবে চিটাগং । মেয়ের বিরহ ভোলাতে সেদিন সবাইকে নিয়ে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে যেতে হোল । কদিন বাদেই নতুন বিপত্তি সামনে এসে দাঁড়ালো । রাস্তার পাশে এক বাদামওয়ালা ছোকরাকে পছন্দ করে ফেলেছে আমার মেয়ে । কাঁদো কাঁদো গলায় এসে বলল , ‘বাবা , আমি ওই বাদামওয়ালা ছেলেটাকে ভালবাসি । বাবা তুমি কি রাগ করলে ?’ গল্প লেখার সময় সবকিছুতেই বিরক্তি লাগে , মেয়ের কান্না ছাড়া । আমি বললাম , ছেলেটি বাদামওয়ালা না হয়ে আইস্ক্রিমওয়ালা হলেই ভাল হত । রোজ ফ্রি ফ্রি আইস্ক্রিম খেতে পারতি । আজ ক্লাসে নোট বুক খুলেই তার চোখে জল এসে যাবে । সেখানে এক হাজার টাকার দুটো নোট আর একটি চিরকুট -“পার্লারে যাবার আইডিয়াটা মন্দ নয়” । পরের পিরিয়ডেই সে বান্ধবী টুম্পাকে নিয়ে ছুটবে নিউ মার্কেট এরিয়ার কোন বিউটি পার্লারে । আমাদের ছেলেটি লেদার টেকনোলজিতে এদেশে পড়া শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে গেছে উচ্চতর শিক্ষার জন্য। ডাকনাম রুবেল , আমি ডাকি চণ্ডীদাস । অল্প বয়স থেকেই সে ভাবুক আর কবি হয়ে উঠেছে । তারও একটি বাতিক আছে । মিথ্যে বলার বাতিক । তার কবিতাগুলো বেশ ভাল মানের । কিন্তু মিথ্যগুলো আরও সুন্দর । উদাহরন দেই । বছর দুয়েক আগের কথা । চণ্ডী বিদেশে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে । এমব্যাসি ফেস করার আগেরদিন হঠাৎ সবগুলো সার্টিফিকেট হারিয়ে ফেললো । ওর মায়েরতো পাগল হবার দশা । আমি ছেলের নির্বুদ্ধিতায় মর্মাহত হয়ে ছুটলাম এম্ব্যাসীতে । যেভাবেই হোক ইন্টার্ভিউয়ের ডেট পেছাতে হবে । ফিরে এসে চণ্ডীদাসকে বাড়ীতে পেলাম না , পেলাম একটি চিঠি । বাবা , মা । আমাকে মাফ করে দিও । সার্টিফিকেটগুলো রফিকের খুব দরকার ছিল । নাম-ঠিকানা পর্যন্ত মনে মনে বদলে ফেলেছে । আমিতো বিদেশে যাবো । ওর কি হবে ? তোমাদের রুবেল রফিক গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের ছেলে । পরীক্ষার আগে বাবা মারা গেলে সবচে মেধাবী ছাত্র হয়েও এবার আর পাস করা হোল না । রফিকের অনুপস্থিতিতে চণ্ডী সবচেয়ে ভাল রেজাল্ট করেছিল । পরে বুঝেছি ও লড়াই করে ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হতে চেয়েছিল , ফার্স্ট নয় । পরের দিন রুবেল ফিরে এলে আমি রাগ করতে পারিনি , বিস্মিত হয়ে তাকিয়েছিলাম । এক বছর পরে অবশ্য রফিক ভাল রেজাল্টসহ পাস করে আমার বিবেককে মুক্ত করেছে । এন জি ওর সে চাকুরীও ছেড়েছে । এখন সে বিসিএস ক্যাডারে , অবশ্যই নিজের সার্টিফিকেটে । ( ২ ) সকালের রোদে বসে ভাবছিলাম বাংলাদেশে ডাক বিভাগের আর কোন প্রয়োজন আছে কিনা । ছুটির সকালে অলস চিন্তার উদাহরণ আরকি । এমন সময় নতুন কাজের ছেলেটা হন্ত দন্ত হয়ে ছুটে এলো । হাতে একটি চিঠি , দুদিন আগেই এসেছে । আগের ছেলেটা রিয়াদ , কাল ছুটিতে গেছে । ঘরে ফেরার আনন্দে যাবার আগে চিঠিটা আমাদের হাতে তুলে দিতে ভুলে গেছে । চণ্ডীর চিঠি ! ভারী অবাক হলাম । কাল রাতেও ওর সাথে কথা হয়েছে ফোনে । একবারও চিঠির কথা বলল না । খামটি খুলতে অনিন্দ সুন্দর এক বিদেশিনী হেসে উঠলো । বাবা , মা । মেয়েটি পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে । টার্ম একজাম পর্যন্ত দিতে পারলাম না সিন্থিয়ার পাল্লায় পড়ে । হ্যাঁ বা না কিছু একটা লিখে দিও । ফোনে কিছু জানতে চেয়ো না , প্লিজ । ভাল থেকো । রুবেল । দুজনে পরামর্শে বসলাম । টার্ম একজাম তো চণ্ডী দিয়েছে । কেন যেন মনে হোল , মেয়েটি নয় ও নিজেই মেয়েটির প্রেমে পাগল হয়ে গেছে । হয়তো মেয়েটিকে একজাম পর্যন্ত দিতে দেয়নি । একজন দায়িত্বশীল বাবা হয়ে অন্যের মেয়ের এমন ক্ষতি হতে দেই কিভাবে ? সিদ্ধান্ত হোল , আগামী এক মাসের মধ্যে রেহানা স্টেটসে যাবে বিয়ের কাজটা ঠিকমত শেষ করার জন্য । ওখানে কিছুদিন থেকে ছেলে আর পুত্রবধুকে নিয়ে দেশে ফিরলে আমাদের মত করে রিসেপ্সন সারা হবে । সে মতে পরদিন একটি ফিরতি চিঠি পাঠিয়ে দিলাম । বিকেলের চা সামনে নিয়ে একা বসে আছি । সাংসারিক কাজে রেহানা গেছে মার্কেটে । এতদিন কল্পনায় ছিল মিষ্টি স্বভাবের একটি বাঙালী মেয়ে আমার ছেলের ঘরের চাবি আঁচলের গোছায় বেঁধে সংসারময় ঘুরে বেড়াবে । ওর চঞ্চল স্বভাবের বিপরীতে সে হবে শান্ত দীঘির মত । কালো কেশ আর কাজল চোখের এক আবহমান বাঙালী নারী । চণ্ডী বিদেশিনী মেয়ে বিয়ে করতে চাইবে , আগে ভাবিনি । বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে । এমন সময় কাজের ছেলেটা খবর নিয়ে এলো , এক ভদ্রমহিলা কথা বলতে এসেছেন । ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই আমার হৃদপিণ্ডের বেগ বেড়ে গেল , ঠিক পঁয়ত্রিশ বছর আগের মত । আমার বয়স তখন সতেরো কি আঠারো । যৌবনের সিঁড়িতে টলোমলো পা । নতুন একটা কল্পরাজ্যও গড়ে উঠেছে । সে রাজ্যে প্রথম অনুপ্রবেশ ঘটেছিল যে মেয়েটির , সেই লতা এমুহূর্তে আমার সামনে বসা । বয়সে আমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় । তার চেহারায় ছিল লাবন্যের জোয়ার , তবে মাদকতা ছিল তারও ঢের বেশী । পতঙ্গের মত ছুটে গেছি বার বার তার রুপানলে আত্মাহুতি দিতে । নীরবে মিষ্টি হেসে ফিরিয়ে দিয়েছে লতা । দূরের হলেও আত্মীয় , অচেনাতো নই । সেটাই হয়তো ছিল স্বাভাবিক । দুটো পরিবারের মধ্যে আসা যাওয়া নিয়মিত না হলেও দুই ঈদে দুবার অন্তত দেখা হয়ে যেত । শহরের অন্য প্রান্তে যে ছোট্ট নদীটি , তারই পাড়ে ছিল ওদের গাছ গাছালী ভরা বাগান বাড়ী । অনেক সম্পদশালী ছিল ওরা । শেষ দিকে মদ আর জুয়া , দুটোতেই আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন পরিবারের কর্তা । দ্রুত সহায় সম্পত্তির মালিকানা বদল হচ্ছিল । আত্মীয় হিসাবে আমার বাবা এই অবিমৃশ্যকারীতার প্রতিবাদ করেছিলেন । এ নিয়ে জীবদ্দশার শেষ প্রান্তে বাবার সাথে লতিফ চাচার ভুল বঝাবুঝি সৃষ্টি হয়। সে ভার সইতে পারেনি দুর্বল সম্পর্কটি । কুশলের কথাগুলো শেষ করেই লতা একটি কার্ড বাড়িয়ে দিল । ওর ছেলে তন্ময়ের বিয়ে , আমাকে থাকতে হবে । আমার কিছু ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা আছে , তা সত্ত্বেও হুট করে না বলা যায় না । কি বলবো ভাবছি , এরই ফাঁকে অন্য একটি খাম থেকে কনের ছবিটি বের করলো সে । দুচোখে নিবিড় প্রশান্তি , কালো চুলে নিদ্রামগ্ন অমারাত , জোছনা ধোয়া মুখাবয়ব , এক অকৃত্রিম বাঙালী নারী । বিস্মিত চোখে তাকিয়ে ছিলাম । লতার কথায় সম্বিৎ ফিরলো , -কই , তোমার বৌকে ডাকলে না ? কথা বলে যাই । নাকি মুখোমুখি করতে এখনো ভয় পাও ! -মেয়েকে নিয়ে মার্কেটে গেছে । একটু বসে যাও । এখুনি এসে পড়বে । এই ফাঁকে আমার সেই সীমাবদ্ধতার কথাটা বলে রাখি । লতার সাথে শেষ দেখা হয়েছিল সাতাশ বছর আগে , এই বাড়ীতেই । রেহানা তখন নতুন বৌ , সেদিন ভাইয়ের সাথে প্রথম বারের মত বাপের বাড়ী বেড়াতে গেছে । ঘরে আমি একা । লতার হাতে ছিল একটি অ্যাপ্লিকেশন । আমার কলেজে একটি শুন্য ক্লারিক্যাল পোষ্টে জব করতে চায় । এসিস্ট্যান্ট প্রোফেসর হলেও ম্যানেজিং কমিটিতে আমার কিছুটা প্রভাব আছে । ক্ষুদ্র এই আজিজ আরেফিনের একটি রিকোমেণ্ডেশন এপ্লিকেশনটিতে যথেষ্ট মূল্যবান বৈ কি । এই প্রত্যাশাই ওকে টেনে এনেছিল । বাইরে আকাশ কালো করে দশ দিগন্ত ছেপে বৃষ্টি এসেছে। ঘন ঘন ঝলকে উঠছে দেয়া । ঘরে কেউ নেই আমি আর সেই মেয়েটি ছাড়া , যার মুখচ্ছবি প্রথম যৌবনে ঘুম কেঁড়ে নিতো প্রতি রাতে , বিনম্র আগ্রাসনে । কেউ ফেরাতে পারে কিনা জানিনা , আমি পারিনি । বর্ষণের সেই দুপুরে একটি নয় দুটি দস্তখৎ করেছিলাম আমি। বাঁধা দেয় নি লতাও । সেই প্রথম , সেই শেষ । পরে অবশ্য চাকুরীটা আদৌ হোল কিনা , সে খোঁজও নেয়া সম্ভব হয়নি । এতদিনে ছেলের বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে আজ ফের আমার দরোজায় । আমি ইতস্তত করে বললাম , -এতো দিন পরে এলে , তোমার ছেলেকেই তো দেখা হয়ে উঠেনি । তার ছবি নেই সাথে ? কি যেন বলতে যেয়ে ওর ঠোঁটদুটো একটু কেঁপে উঠে আবার থেমে গেল । সামলে নিয়ে বলল , -নেই । এ আর এমন কি ? কালই না হয় তন্ময়কে পাঠিয়ে দেবো । তোমাকে সালাম করে যাবে । হাতের একগাদা কার্ডের দিকে ইশারা করে লতা উঠে দাঁড়ালো , আজ তবে আসি । একটুও সময় নেই । বৌ আর মেয়েকে নিয়ে ঠিকঠাক চলে এসো কিন্তু । মিষ্টি হেসে পা বাড়াল সে । ( ৩ ) পরদিনই দেখা করতে এসেছিল ছেলেটি । আমি তখন মাত্র জগিং শেষ করে এসে সরাসরি বাগানের যত্নে লেগে পড়েছি । পরনের ট্রাকস্যুট , সানগ্লাস কিছুই খোলা হয়নি । হঠাৎ গেটে দাঁড়ানো তন্ময়কে দেখে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম । এও কি সম্ভব ! আমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে আমার ক্লোন । হাত , পা , চুল , চোখ এমনকি চোখের চাউনি সবই হুবহু আমার মত । স্কন্ধের ওপর বসানো অবিকল যেন আমার মুখখানি ! আমার হাতের তালু ঘেমে গেল , গলা শুকিয়ে কাঠ । বুকের ভেতর কেউ হাতুড়ী পেটাচ্ছিল । ভাগ্যিস কাছেপিঠে কেউ ছিল না । একরকম অভদ্রতা করেই তাড়াতাড়ি আপদ বিদায় করলাম । ছেলেটি চলে যাবার পর চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম দুদণ্ড । ভেসে উঠলো চণ্ডীর মুখ , মনে পড়লো টিউলিপের কথা । আর রেহানা , অকুণ্ঠ শ্রদ্ধায় প্রতিদিন যে প্রাণদায়ী ভালবাসা সিঞ্চন করে চলেছে আমার শেকড়ে । চোখ না মেলেই দেখতে পেলাম কিভাবে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে দূরে চলে যাচ্ছে আমার বন্ধুজন , আত্মীয় , প্রতিবেশী আর পরিচিতজনেরা । নিমিষেই হিসাবটা ধরে ফেললাম , সাতাশ বছর আগে যে টোপ আমাকে গেলানো হয়েছে আজ সে বড়শীটি গুটিয়ে ঝুড়িতে শিকার তুলতে চাইছে লতা । নিশ্চয় এতদিন আমার গতিবিধি নজরে রেখেছিল গোপনে । কি চায় ও আমার কাছ থেকে ? টাকা ! পরিচয় ! প্রতিহিংসা ! পৈত্রিক শত্রুতা ! প্রথমটাই ঠিক , টাকা চাই তার ! নিঃস্ব করে গেছে সিরাজ চাচা । ব্লাক মেইল , মনে হচ্ছে মা-বেটা মিলে এঁটে সেঁটে নেমেছে । প্রথমে নিজে এসে একটা ধাঁধাঁ তৈরি করেছে । পরে ছেলেকে পাঠিয়েছে নীরব হুমকি স্বরূপ । সারা রাত নির্ঘুম এপাশ ওপাশ করে কাটালাম । সকালে সবাই জাগার আগেই ল্যান্ড ফোনের পাশে মোড়া পেতে বসে রইলাম আমি । জানি একটি কল আসবে , যে কোন সময় । শরীর খারাপের বাহানা বানিয়ে কলেজে যাবার ঝামেলা মিটিয়ে দিয়েছি । ভীষণ উত্তেজনার মধ্য দিয়ে সময় গড়াচ্ছে টিক টিক টিক । মোবাইলে আননোন বা আনসেভড কোন নাম্বার থেকে কল এলেই ছুটে যাচ্ছি এক কোনে । রেহানা বোধহয় সন্দেহ করতে শুরু করেছে । মুখে কিছু বলছেনা , কিন্তু কেমন যেন সরু সরু চোখে তাকাচ্ছে আমার দিকে । তিন দিন কেটে গেল , এখনো কল আসেনি । একটুও ঘুমুতে পারছি না । কাল রাতে রেহানা কাঁদছিল । হাত ধরে টানাটানি করছিল , ছাদে নিয়ে যাবে জোছনা দেখাতে । আহাম্মকি ! যত্ত সব আহাম্মকি ! জোছনা দেখাবার কি আছে ? এখন ও কি একটু শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে ? কানের কাছে একটা প্রশ্ন নিয়ে বারবার ঘ্যান ঘ্যান করেছে , কি হয়েছে , কি হয়েছে ? সন্দেহ হচ্ছে , লতা শুধু আমাকে নয় , আমার স্ত্রীকেও ব্লাক মেইল করতে পারে । আচ্ছা , কত টাকা চাইতে পারে , বিশ লাখ ! ত্রিশ লাখ ! আমার গ্রাচুয়িটির পরিমান জেনে নিয়ে থাকলে দাবীর অংক পঞ্চাশ লাখে যেয়ে ঠেকতে পারে । রেহানাকে না জানিয়ে জীবনের সব সঞ্চয় এভাবে ডাকাতের হাতে তুলে দেব ! না কি ওকে ডেকে এখুনি সব স্বীকার করে আইনি লড়াইয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়া ঠিক হবে ? এরপর আর কি কখনো টিউলিপ তার গোপন কথাটি বাবার সাথে শেয়ার করতে আশেপাশে ঘুরঘুর করবে ? চণ্ডী কি বাবার ভেতর আর কখনো খুঁজে পাবে একজন অকৃত্রিম বন্ধুকে ? স্ত্রীর সাথে গড়ে ওঠা মধুর সম্পর্কটি কি আজই শেষ হয়ে যাবে ! আর কি কোন তুমুল বৃষ্টির দুপুরে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রেহানা বলবে না , ছেলেমেয়েরা বাড়ীতে নেই , চল না কিছুক্ষন ফুল বাগানে যেয়ে দাঁড়াই । চোখ দুটো বারবার ভিজে উঠছে , কাঁদতে পারছি না । আজও সকাল থেকে দুপুর অব্দী যুগপৎ গেট আর ফোনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কাটিয়ে দিলাম । হঠাৎ মনে হলো টেলিফোনের লাইনটা কেটে দিলে কেমন হয় ! ঐতো যন্ত্রটার পেছনে লেজের মত তারগুলো নেমে গেছে । একটি ছোট্ট প্লাস হাতে নিয়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম । এরপর কি হয়েছিল মনে নেই । চোখ মেলে দেখি আমি হাসপাতালে । এরিমধ্যে নাকি তিনদিন গড়িয়ে গেছে । ইলেকট্রিক শক খেয়ে হার্টের রিদমে মারাত্মক সমস্যা দেখা দিয়েছিল । আমি নাকি মরতে বসেছিলাম । চারিদিকে চেয়ে বুঝতে পারলাম , সত্যি বেশ কয়েকটি যন্ত্রে বেঁধে ছেধে আমাকে আটকে রাখা হয়েছে । আস্তে আস্তে সবই আমার মনে পড়তে লাগলো । টেলিফোনের তার কাটতে যেয়ে ভুলক্রমে সম্ভবত পাশে রাখা টেলিভিশনের তার কেটে ফেলেছিলাম । ফলাফল ইলেকট্রিক শক , হাসপাতাল । আমার জ্ঞান ফিরেছে জেনে হার্ট স্পেশালিষ্ট দেখা করে গেলেন । তারপর লম্বা , কুঁজো মত এক ভদ্রলোক এসে গল্প করতে শুরু করলেন । অমায়িক , ভীষণ গল্পবাজ । কিছুক্ষণ পরে নিজেই পরিচয় দিলেন , সাইকিয়াট্রিস্ট , ডাঃ আশফাক আহমেদ । এই পেশার প্রতি চিরদিন আমার একটি নীচু ধারনা আছে । কিন্তু এই লোকটি অন্যরকম । গল্পচ্ছলে কত সহজেই না ঢুকে গেলেন আমার ভেতরে । এটা ধরেন তো ওটা নাড়েন । একসময় ঠিকই ধরে ফেললেন গোলমেলে সম্পর্কটি , ওনার ভাষায় শর্ট সার্কিট । এবার আর দাঁড়ালেন না , কয়েকটি প্রয়োজনীয় নাম-ঠিকানা আর ফোন নম্বর নিয়ে বললেন , কাল আবার আসবো । পরদিন অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করলাম , তিনি এলেন না । এদিকে হাসপাতাল থেকে ছাড়ার সময় হয়েছে । তিনি এলেন তৃতীয় দিন । আমার আর তর সইছে না । প্রশ্ন করলাম , -কি খবর ডাক্তার সাহেব ? -খবর ভাল । আমার এক বন্ধু আছে টি এন্ড টিতে । তাকে দিয়ে গত এক সপ্তাহে আপনার ল্যান্ড ফোন আর মোবাইলের ইন কামিং কললিস্ট ঘেঁটেছি । কোন অপরিচিত কল আসেনি এসময়ে । ডাক্তারের কথায় আমি একটু একটু করে মনে শক্তি ফিরে পাচ্ছিলাম । -তবে কি অন্য কোন ভাবে ওরা যোগাযোগ করবে ? মানে সশরীরে , সরাসরি ? -আমার তা মনে হয়নি । সত্যি বলতে কি বিষয়টা আপনার জন্য যত শক্ত বা জটিল ভাবছেন , ওদের সামাজিক অবস্থান থেকে আরও বেশী । আমার মনে হয়না টাকার জন্য মিসেস লতা আপনার পিছু নিয়েছেন । আমার মুখাবয়বে প্রশান্তির রেখাগুলো ভেসে উঠতে শুরু করেছে । -তবে কি কারনে এসেছিল মনে করেন ? -হয়তো হেয়ালী । হয়তো সাতাশ বছরের লম্বা সময়ে মিসেস লতা আপনার চেহারাও খানিকটা ভুলে গিয়েছিলেন । আপনাকে দেখে দাওয়াত করতে আসার ভুলটা ধরতে পেরেছিলেন । তাই আপনি যাতে না আসেন সে জন্য পরদিন ছেলেকে পাঠিয়েছেন । -এবার ছেলেতো নিজেই জানে নিল সে দেখতে কার মত । -আপনার মুখাববয়ব অনেকটাই দাড়িতে ঢাকা , তাছাড়া চশমা ছিল চোখে । আপনার সাথে ছেলেটির সাদৃশ্য আপনি যেভাবে দেখেছেন , তন্ময় সে ভাবে দেখতে পাবার কথা নয় । তারপরও যেটুকু ঝুঁকি থেকে যায় মিসেস লতার পক্ষে সেটুকু এড়ানো সম্ভব ছিল না । -জানেন ডাক্তার ছেলেটাকে দেখে আমার মোটেও ঘৃণা হয়নি , ভয় পেয়েছিলাম । প্রথমে মনে হয়েছিল বুকে জড়িয়ে ধরি । আমারই রক্ত মাংস , হুবহু আমার মত । ছেলেটির জন্য আমার কিছু করতে ইচ্ছে করছে । -কিছুই করতে হবে না । বিধাতা তার সৃষ্টিকে শুধু শুধু কষ্টে রাখেন না । কে জানে , হয়তো সেও ভাগ্যবান । নিজের বাবাকে না পেলেও হয়তো একজন সুন্দর মানুষকে বাবা ডাকছে সারা জীবন ! জানতে ইচ্ছে হোল ডাঃ আশফাক নিজেই যেয়ে ওদের বাড়ীতে সব দেখে এসেছেন কিনা । কিন্তু ততক্ষনে বেশ কয়েকজন নার্স দাঁড়িয়ে পড়েছে একটু দূরে ডাক্তারের অপেক্ষায় । আর দেরী না করে শেষ প্রশ্নটা করে ফেললাম । -আমার স্ত্রী কি লতার ব্যাপারটা জানে ? -কাল রাতে আমার সাথে ইন্টার্ভিউ ছিল ওনার , কিছুই জানেন না । অবশ্য আজ অন্য কোথাও থেকে কিছু জেনে থাকলে সেটা ভিন্ন । ( ৪ ) হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেছি দশ দিন হয়ে গেল । আজ রাতে রেহানার ফ্লাইট , ছেলের কাছে যাচ্ছে । আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে । সকাল থেকে থমথমে ভাব । ড্রয়িং রুমে বসে না দেখা ম্যাগাজিনগুলো উল্টাচ্ছিলাম । হঠাৎ ম্যাগাজিনটির ভেতর থেকে একটি ইনভাইটেশন কার্ড ফস্কে পড়লো মেঝেতে , তন্ময়ের । চোখের সামনে মেলে ধরতেই এবার বিস্ময়ে কাঁটা দিল গায়ে । বরের মায়ের স্থানে নাম লেখা হয়েছে , মুনীরা পারভীন লতা । বাবার স্থানে , ডাঃ আশফাক আহমেদ ! একই সাথে একটি আনন্দ আর একটি হাহাকারের জন্ম দিয়ে এই কদিনের অস্থিরতাটি আমাকে ছেড়ে উড়ে গেল অন্য ঠিকানায় । বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে । আমার কাঁধে রেহানার হাতদুটি বেড়াতে এসেছে । এবার তপ্ত নিঃশ্বাস পড়লো গ্রীবায় , ‘বৃষ্টি এলো , ভিজবে নাকি ফুল..............!’ কথাগুলো শেষ হবার আগেই ছুটে বাইরে চলে এলাম । কেউ জানুক , না জানুক , আকাশটাকে জানিয়ে যাবো আমি । আকাশের কান্নার মাঝে মিলিয়ে দেবো পেয়েও না পাওয়া সন্তানের জন্য জমে ওঠা দুফোঁটা অশ্রু । পুনশ্চ- প্রিয় পাঠক , শুরুতে মনের ঘর দেখাব বলে ডেকেছিলাম । জানা ছিল না আমার সে ঘরে আছে শুন্যতা , বিবর । মনের ঘরের শুন্যাতাকে সদাই আমরা অস্বীকার করি । সেখানে বাস করে গোপন স্খলন । খুব নীরবে সে শুন্যতা তুলে রাখে সব পাপ , পাপের পদচিহ্ন । আমরা ভুলে যাই , সাধু সাজি । একদিন জীবাশ্মের মত সব কিছু সামনে মেলে ধরে বিবর । এক অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মমকে। বাইরে পৌষের সকাল, হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা। ভিতরে এসি চলছে ফিসফিস শব্দে। তবুও ঘামছে মম। ওর নাকের ডগায় ক’ফোঁটা ঘাম। অপারেশন থিয়েটারের বাড়তি আলোয় ঝলমল করছে। সংবাদ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এখনও ডাক্তার ম্যাম এসে পৌঁছাননি। কাছে-পিঠে আর একটা হাসপাতাল রয়েছে। এই মুহূর্তে সেখানে তিনি একটা অপারেশন করছেন। সেটা শেষ করে সোজা এখানে চলে আসবেন। ধবধবে সাদা বিছানায় টানটান শুয়ে আছে মম। ওর পুরো শরীরটা একটা নরম কাপড়ে ঢাকা। স্যাভলনের গন্ধ তাতে। চোখের সামনে চুনকাম করা ঝকঝকে সিলিং। কষ্টের মধ্যেও চিকন একটা হাসির রেখা ফুটল মমর ঠোঁটের কোণে। তার যুদ্ধ আজ শেষ হতে চলেছে। শব্দ করে কারো মোবাইল ভাইব্রেট করছে। ঘাড় ঘুরিয়ে নার্সকে মোবাইল রিসিভ করতে দেখল মম। ‘জ্বি ম্যাডাম। রেডি। জ্বি, এনেসথেসিয়া দিয়ে দিচ্ছি।’ নার্সদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ল। একজন নিচু স্বরে বললো, ‘ম্যাডাম চলে এসেছেন। আমরা এখন আপনাকে রেডি করব।’ মা’র মুখটা ভেসে উঠল একবার মমর চোখের সামনে। তারপর বাবার। তারপর ইকবালের। এনেসথেসিয়ার প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে বোধ হয়। তলপেটের দিকটাতে এখন আর কোন সাড়া নেই। ‘কি চাও তুমি? তোমার মতো আমিও চাকরিটা হারাই?’ অনেক দূর থেকে কেউ যেন মমকে উদ্দেশ্য করে বলছে কথাগুলো। ইথারে ভেসে আসছে তা মমর কানে। মম চোখ বুজল। দু’চোখ উপছে জল গড়িয়ে নামল কানের পাশ দিয়ে। দুই চৈত্রের মাঝামাঝি তখন। খুব গরম পড়ছিল সেই ক’দিন। বাড্ডায় মমরা যে বাসাটায় ভাড়া থাকে সেটা ছয় তলা। মমরা বলতে মম আর ইকবাল, স্বামী-স্ত্রীতে মিলে দু’টো মাত্র প্রাণী। পাঁচতলায় দক্ষিণের ইউনিটের আড়াই রুমের এপার্টমেন্টটা নিয়ে ওরা রয়েছে বছর দুয়েক। ওদের দাম্পত্য জীবনের বয়সও ওই দুই বছর। বিয়ে করে মমকে এনে তুলেছিল ঐ বাসায়। ইকবালের অফিস মালিবাগে, মমর গুলশানে। বাসাটা তাই মোটামুটি মাঝামাঝি জায়গায় নেওয়া, যাতে দু’জনেরই যাতায়াতের সুবিধা হয়। মমদের বাসার দক্ষিণের পাশটা এখনও ফাঁকা। কোন একটা ডেভলপার জায়গাটা নিয়েছে, বড়-সড় একটা বিলবোর্ড লাগিয়েছে, কিন্তু এখনও কনস্ট্রাকশনের কাজ শুরু করেনি। গরমের দিনে দক্ষিণের বারান্দাটায় এসে বসে মমরা। যখন লোডশেডিং মাত্রা ছাড়ায় তখন রাত্রিবেলা দক্ষিণের জানালাদু’টো খোলা রেখেই ঘুমোয়। সেদিন একটু আগে ভাগেই ঘুমিয়ে পড়েছিল ইকবাল। সব কাজ গুছিয়ে মমর শুতে শুতে প্রায় এগারোটা। হঠাৎ মাঝরাতে ঝড় উঠল। সেটাই ছিল বছরের প্রথম কালবৈশাখী ঝড়। সেদিনের সেই কালবৈশাখী ঝড়টা যেন একটা রূপক! সেই ঝড়ের রাতেই প্রথম মম শুনতে পেয়েছিল একটা ঝড়ো বাতাসের আগমন ধ্বনি, তার দু’বছরের সংসার জীবনে। ঝড়ে ধুলো উড়ছিল বাতাসে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল আকাশের বুক ফালি ফালি করে, দু-একফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছিল। ওপাশের ঘরের জানালা-দরজা আটকে দিয়ে এসে মশারি গুঁজে ইকবালের পাশে শুতে যাবে তখনই কথাটা মনে পড়ল মমর। ইকবাল তখনও দিব্যি ঘুমোচ্ছে, বাইরের ঝড়-বৃষ্টিতে তার রা নেই। মম কনুই দিয়ে আলতো করে গুঁতো দিল, ‘কই শুনছো?’ তবুও ইকবালের কোন সাড়া নেই। ওর-ই বা কী দোষ! সারাদিন অফিসে গাধার খাঁটুনি। আবার তো উঠতে হবে কাল কাক-ডাকা ভোরে! ‘কই, শুনছো?’ ইকবালের চুলে আঙুল দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে আবার বললো মম। ‘হুম।’ এবার ছোট্ট সাড়া দিল ইকবাল। ‘আমার তো ডেট ছিল গত সোমবার। আটদিন হয়ে গেল, কিন্তু এখনও তো হলো না।’ ‘কিসের ডেটের কথা বলছো?’ ইকবালের কণ্ঠে জড়ানো ঘুম। ‘কিসের আবার? আমার পিরিয়ডের।’ বললো মম। এবার একটু চোখ পিটপিট করে তাকাল ইকবাল, ‘হয়নি হবে। এখন ঘুমোও তো, সকালে অফিস আছে।’ তার গলায় বিরক্তি। ‘অফিস তো আমারও আছে। এই শোন না, আমার খুব টেনশন হচ্ছে।’ বললো মম। ‘এত টেনশনের কি আছে?’ উড়িয়ে দিতে চাইল ইকবাল। তবুও মমর মন মানছিল না, ‘আছে। আমার তো কখনো এমন হয় না, তুমি জানো।’ একটু দম নিল মম, ‘তুমি কালই একটা স্ট্রিপ নিয়ে এসো। আমি প্রেগনেন্সি টেস্ট করব।’ ‘তুমি অযথা-ই টেনশন করছো। তুমি খুব ভালো করেই জানো, আমরা শুধু সেফ দিনগুলোতে...।’ ‘তারপরও। আমার সন্দেহ হচ্ছে।’ মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললো মম। ইকবাল পাশ ফিরে শুলো। পরের দিন প্রেগনেন্সি টেস্টের স্ট্রিপ নিয়ে এলো ইকবাল অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময়। রাতটা ভীষণ দুশ্চিন্তা-ই কাটল মমর। ওরকম-টা হওয়ার কোন কারণ নেই জানে। তবুও। যদি সন্তান চলে আসে! এ মুহূর্তে সন্তান আসার অর্থ মমকে চাকরি ছাড়তে হবে। প্রতি মাসে ইকবালের বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয়। সেখানে ওর বাবা-মা রয়েছে। ছোট একটা ভাই, একটা বোন রয়েছে- দু’জনই পড়ছে এখনও। এদিকে নিজেদের সংসারে হাজারও খরচ। স্বামী-স্ত্রী দু’জন মিলে চাকরি করেই মাস চালানো ভার। তার উপর যদি মমকে চাকরি ছাড়তে হয় তাহলে তো না খেয়ে থাকতে হবে! মম ভাবতেই পারছিল না। ভোররাত্রে যখন ইউরিনে স্ট্রিপ ডুবাল তখন তাতে ভেসে উঠল খুব উজ্জ্বল দু’টো দাগ। তা দেখেই কপালে ভাঁজ পড়ল মমর। দু’টো দাগের অর্থ সে জানে। সে প্রেগনেন্ট। কিন্তু? কোথা থেকে যে কি হলো! শোবার ঘরে ইকবাল তখনও ঘুমে অচেতন। একবার ভাবল তাকে ডেকে তুলে সংবাদটা দেয়। পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত বদলাল। হাত লাগাল রান্নার কাজে। কিছুক্ষণবাদে ইকবাল ঘুম থেকে উঠল। উঠেই সোজা কিচেনে। ‘কি খবর?’ জানতে চাইল মমর কাছে। মম বুঝল, আগের রাতে ‘এখন ঘুমোও তো, সকালে অফিস আছে’ বলে ইকবাল যতই ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিক না কেন ভিতরে ভিতরে সেও যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিল এটা নিয়ে। অন্যদিন ঠেলেঠুলে ঘুম থেকে ওঠানো যায় না। আজ নিজে নিজেই সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে চলে এসেছে রান্নাঘরে। মম চুপ করে রইল। তার মুখ ভার। সেটা দেখেই কিছুটা অনুমান করতে পারল ইকবাল। তারপরও মমর মুখ থেকে সে শুনতে চায়। মম কথাটা বলতেই নিজের মাথার চুল টানতে লাগল ইকবাল। বললো, ‘কিন্তু কিভাবে? আমরা তো শুধু সেফ দিনগুলোতেই...।’ ‘সেফ দিনগুলো সব সময় সেফ নয়।’ মম বললো, ইকবালের দিকে না তাকিয়েই। ইকবাল কোন কথা না বলে বাথরুমে ঢুকল। ফ্রেশ হয়ে এসে আবারও দাঁড়াল মমর পাশে, ‘এখন কি করবে ভাবছো?’ ‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’ বললো মম ধরা গলায়। ‘একবার আল্ট্রাসনো করলে কেমন হয়? স্ট্রীপের রেজাল্ট তো ভুলও হতে পারে।’ বললো ইকবাল। এ কথাটা যে মম ভাবেনি তা নয়। আল্ট্রাসনোগ্রাম তো অবশ্যই করবে কিন্তু সেটা আরও কয়েকদিন পর। এখন করলে কিছুই বোঝা যাবে না। কাজেই এ মুহূর্তে ধৈর্য্য ধরা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। সেদিন অফিসে গিয়ে কাজে মন বসাতে পারল না মম। লাঞ্চের পরে প্রতিদিনের মতো একবার ফোন করল ইকবালকে। কিন্তু অন্যদিনের মতো কথোপকথন ঠিক জমল না। বারবারই সকালবেলার টেস্টের রেজাল্টটা মাথা গলিয়ে দিতে লাগল এ-কথা ও-কথার ফাঁকে। অবশ্য সেদিন রাতে ইকবাল বাসায় ফিরল একটু হালকা মেজাজে। ফিরেই মমকে বললো, ‘শোন, অনেক ভেবে চিন্তে দেখলাম, অযথা টেনশন করার কিছু নেই। সন্তান আসলে আসুক। এমন তো না যে আমরা কখনোই সন্তান নেব না। কাজেই শুভস্য শীঘ্রম।’ বলে হাসল একটু। ইকবালের কথায় একটু হালকা বোধ করল মম। কিন্তু পুরোপুরি ভারমুক্ত হতে পারল না। এই মুহূর্তে সন্তান এলে তার ক্যারিয়ারের কী হবে? সাড়ে-তিনবছর ধরে অক্লান্ত খেটে এই প্রতিষ্ঠানে নিজের একটা স্থান করে নিয়েছে সে। এ রকম একটা চাকরি এখন যদি হারাতে হয়! ইকবালকে বললো, ‘সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু সন্তান মানুষ করতে গিয়ে যদি আমাকে চাকরি ছেড়ে দিতে হয় তাহলে কি হবে? তুমি একা পারবে সংসার চালাতে?’ একটু দমে গেল ইকবাল, তারপরও ফুসফুস ভরল বাতাসে, ‘সে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আর তোমাকে চাকরি ছাড়তে হবে কেন? তুমি ছুটি নেবে। এখন তো সব কোম্পানি মাতৃত্বকালীন ছুটি দেয়।’ ‘তুমি আমার কোম্পানীর বিষয়ে জানো না। এখানে বেতন ভালো, সুযোগ-সুবিধাও খারাপ না। কিন্তু এই ব্যাপারটাতে! কোম্পানী আমাকে ঠিকই ছুটি দেবে কিন্তু তারপরে কোন না কোন একটা কারণ দেখিয়ে আমাকে বের করে দেবে।’ বললো মম। ‘তুমি এতটা শিওর হচ্ছো কিভাবে?’ ইকবালের মাথায় আসলেই ঢুকছিল না। ‘সুমাইয়া আপুর কথা তো তুমি কিছু জানো না। বাচ্চা হওয়ার পরে উনি আর অফিসে টিকতে পারেননি।’ বললো মম। ইকবাল চুপ করে গেল। এঘর-ওঘর পাইচারি করল কিছুক্ষণ। তারপর রিমোট নিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে বসল সোফায়, টিভিতে খেলার চ্যানেল ছাড়ল। মম চলে গেল কিচেনের দিকে। সপ্তাহ দু’য়েক পরে আল্ট্রাসনোগ্রাম করা হলো। ঠিক তাই! জানা গেল মম মা হতে চলেছে। ঠিক এই সময়ে আরও কিছু উপসর্গ দেখা দিল মমর শরীরে। সে ঠিকমতো খেতে পারে না, খেতে গেলেই বমি বমি লাগে। রাতে ঘুমোতেও পারে না ঠিকমতো। মমর মনে হচ্ছিল সময়ের সাথে সাথে এগুলো একসময় সয়ে যাবে। কিন্তু ব্লিডিং এর ব্যপারটা! প্রায়ই রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। সেই সাথে দেখা দিল আরও কিছু মেয়েলী সমস্যা। একদিন অফিস শেষে ইকবালকে নিয়ে মম ছুটল ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার ম্যাম বললেন ‘কমপ্লিট রেস্ট নিতে হবে। অন্তত দু-তিনমাস।’ শুনে মমর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তাহলে অফিস? কিছুদিনের ছুটির কথা বলতেই মমর অফিসের বস সোজা না করে দিলেন। তখন চোখে সরষে ফুল দেখতে লাগল মম। সব শুনে ইকবাল বললো, ‘চলো, তাহলে এবরশন করে ফেলি।’ ইকবাল এমন একটা কথা বলবে ভাবতে পারেনি মম। প্রথমটায় তাই নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। আঁতকে উঠে বললো, ‘মানে?’ ইকবাল একটু সময় নিল, ‘দেখো, এই অবস্থায় তোমার চাকরিটা আমাদের দু’জনের জন্য, আমাদের সংসারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণেই বলছিলাম।’ যে সন্তান তিলে তিলে বড় হচ্ছে তার গর্ভে তাকে নষ্ট করার কথা কিছুতেই ভাবতে পারে না মম। এত বড় পাপ সে করবে না মরে গেলেও। ‘আমি কিছুতেই পারব না। কিছুতেই না।’ বললো মম। ‘তাহলে করো তোমার যা ইচ্ছা।’ বললো ইকবাল। তারপর পাশ ফিরে শুলো। সেরাতে ঘুম আসছিল না মমর। বিছানায় এপাশ ওপাশ করে কাটাল অনেক রাত পর্যন্ত। ওর পাশে ইকবালের ভারী নিঃশ্বাস। কিচেনে ঢুকে চা করল মম। তারপর দক্ষিণের বারান্দায় বসল। সামনের খালি জায়গাটাতে উঁচু করে বসানো বিলবোর্ডটার উপর চোখ পড়ল। ‘হ্যাপি নেস্ট।’ দারুণ তো নামটা! এখানে ওরা মাঝে মাঝেই বসে। আগে কখনো চোখে পড়েনি তো নামটা! ডেভেলপার বাড়ি বানিয়ে এপার্টমেন্ট বিক্রি করবে। এক-একটা এপার্টমেন্ট হয়ে উঠবে এক-একটা সুখী নীড়! মমর হঠাৎ কান্না পাচ্ছিল। মায়ের সাথে কথা বললো মম একদিন। তারপর মনে জোর পেল অনেকটা। শারীরিক অসুস্থতা আর মানসিক চাপ নিয়েই মম অফিস করতে লাগল সকাল-সন্ধ্যা। দু’হাতে সামলাতে লাগল সংসার। শুরুতে যেসব শারীরিক সমস্যা হচ্ছিল তাও যেন একটু একটু করে কমতে লাগল। ‘আচ্ছা, বলো তো, আমাদের কি হবে? ছেলে নাকি মেয়ে?’ একদিন জানতে চাইল ইকবাল। অনেকদিন পর সেদিন তাকে বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছিল। রাতে খাবার পরে দু’জনে বসে ছিল ওরা ওদের দক্ষিণের বারান্দায়। এ-ক’দিনে এবরশনের চিন্তা থেকে তাহলে সরে এসেছে ইকবাল! ইকবালের প্রশ্ন শুনে মমর তাই মনে হলো। ‘আমাদের মেয়ে হবে।’ নির্দ্বিধায় বললো মম। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে। ‘তুমি কিভাবে জানো?’ জানতে চাইল ইকবাল। ‘আচ্ছা তার আগে বলো, তুমি কি চাও? কি হলে তোমার বেশী ভালো লাগবে?’ উল্টো প্রশ্ন করল মম। ‘দেখো, এখন যে অবস্থা দু’টো সন্তান মানুষ করা সো টাফ। কাজেই আমরা একটাই নেব। যদি প্রথম সন্তান ছেলে হয় তাহলে আর ট্রাই করব না। কিন্তু যদি মেয়ে হয়, তাহলে তো আবার ট্রাই করতে হবে। আর সেটা আমি চাই না। তাই আমার ইচ্ছে আমাদের ছেলে হোক।’ বললো ইকবাল। মমর ধারণা ছিল ইকবাল হয়তো বলবে মেয়ের কথা। বলবে মেয়ে হলেই সে বেশি খুশি হবে। ছেলেরা তো অধিকাংশ সময় প্রথম সন্তান মেয়েই চায়! তাছাড়া ইকবাল শিক্ষিত, ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়েছে, ভালো পরিবেশে মানুষ হয়েছে। অথচ সেও এই রকম একটা ধারণার বৃত্তে বন্দী! অনেক কথাই বলতে ইচ্ছে করছিল ইকবালকে। কিন্তু কিছুই বলতে পারল না। বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল কষ্ট। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মম শব্দ করে। ‘তুমি কষ্ট পেলে? আচ্ছা, এখন জানা যায় না আমাদের কি বেবি আসছে?’ জানতে চাইল ইকবাল। ‘হুম।’ ছোট করে বললো মম। ‘তাহলে চলো, আল্ট্রাসনো করি।’ ‘কোন দরকার নেই।’ বললো মম। ইকবালকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে চলে গেল ঘরে। বিছানা তৈরি করতে লাগল শুয়ে পড়বে বলে। কিন্তু আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে হলো। ডাক্তারের পরামর্শেই করতে হলো। সেদিনও ইকবাল গিয়েছিল মমর সাথে। মমর সত্যিই কোন আগ্রহ ছিল না আগেভাগে তার অনাগত সন্তানের লিঙ্গ-পরিচয় জানার। কিন্তু ইকবালের জন্যই সে জানতে চাইল ডক্টর ম্যামের কাছে। মমর কথা শুনে আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে করতেই তিনি উল্টো প্রশ্ন করলেন মমকে, ‘আপনি কি চান? ছেলে না মেয়ে?’ মম বললো, ‘মেয়ে।’ বললো সত্যি, কিন্তু প্রাণপণে চাচ্ছিল তার এই চাওয়াটা পূরণ না হোক। তার নিজের জন্য নয়, ইকবালের জন্য। হয়তো ইকবালের মা-বাবার জন্যও। কিন্তু মমকে বিষাদে ডুবিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন ম্যাম, ‘আপনার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। আপনাদের মেয়ে হতে যাচ্ছে।’ খবরটা শুনে সেদিন ডাক্তারখানায় পুরোটা সময় মুখ কালো করে ছিল ইকবাল। বাসায় এসেই সে জানিয়ে দিল তার সিদ্ধান্ত, ‘তুমি এবরশন করে ফেল। শুধু শুধু ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই।’ ‘তুমি এটাকে ঝামেলা বলছো?’ বললো মম। ‘ঝামেলা ছাড়া কি? ছেলে হলেও না হয় কথা ছিল!’ বললো ইকবাল। বাথরুমে ঢুকল। চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে রেরিয়ে এলো। এসেই বললো, ‘বাচ্চার জন্য এত উতলা তো তুমি ছিলে না। তাহলে এখন এবরশন করতে এত বাধছে কেন?’ ‘আমি সন্তানের জন্য উতলা ছিলাম না। কিন্তু তাই বলে! আর আমি চাইলেও এখন আর তা সম্ভব নয়।’ ‘কেন সম্ভব নয়?’ ইকবাল যেন বেপরোয়া হয়ে উঠল। ‘বেবি বড় হয়ে গেছে। তাছাড়া এটা আমাদের প্রথম বেবি। এবরশন করতে গেলে অনেক বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। চিরজীবনের জন্য আমি মা হওয়ার ক্ষমতাও হারাতে পারি।’ বললো মম। শান্ত কণ্ঠে। ‘তুমি সব জেনে বসে আছো না?’ ইকবাল চোখ রাঙাল। মম প্রত্যুত্তর করল না। ইকবালও চুপ করে গেল। ইকবাল ওর বাড়িতে মমর মা হতে যাওয়ার খবরটা প্রথমটাতে বলেনি। সন্তানের লিঙ্গ পরিচয় জানার পরে যখন সে সবকিছু বললো তখন মমর শ্বাশুড়ি মমকে ফোন করেছিলেন। সরাসরি কিছু বলেননি, কিন্তু আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়েছিলেন, পরামর্শ দিয়েছিলেন বাচ্চা নষ্ট করে ফেলতে। মম বুঝেও না বোঝার ভান করেছিল, হ্যাঁ-হুঁ করে ফোন রেখে দিয়েছিল। এরপরও মা-ছেলের মধ্যে এ নিয়ে কথা-বার্তা চলছিল এটা বুঝতে পেরেছিল মম, কিন্তু অতটা গা করেনি। মনে মনে সিদ্ধান্তটা সে নিয়েই ফেলেছিল। আর ধরে নিয়েছিল, এটা তার জন্য একটা যুদ্ধ। আর এটাও বুঝে গিয়েছিল এ যুদ্ধটা তার শুধুই একার। কষ্ট হতো। ভীষণ কষ্ট হতো মমর। যখন চোখের সামনে ইকবাল একটু একটু করে বদলে যাচ্ছিল। যখন বদলে বদলে যেতে যেতে একটু একটু করে অচেনা হয়ে উঠছিল ওর কাছে! সূর্যের তেজ কমে এসেছে, দিনগুলো ছোট হয়ে এসেছে অনেকটা। পাঁচটা বাজতে না বাজতেই এখন আঁধার ঘনিয়ে আসে রাস্তায়। তাছাড়া মমও আগের মতো হাঁটাচলা করতে পারে না। সে কারণে অফিসে মাতৃত্বকালীন ছুটি চাইল মম। বস বললেন, ‘দেখছেন তো অফিসে কাজের কত চাপ। এর মধ্যে কিভাবে আমি আপনাকে লম্বা ছুটি দিই বলেন তো?’ ‘কিন্তু স্যার!’ মম বোঝানোর চেষ্টা করল বসকে। কিন্তু বসের সেই একই কথা, ‘আরও কিছুদিন করার চেষ্টা করেন।’ যখন বুঝল সোজা আঙুলে কাজ হবে না তখন মম একটু আঙুল বাঁকা করার চেষ্টা করেছিল। বসও বাঁকা কথা বলে দিলেন মুখের উপর, ‘তাহলে আপনার জায়গায় আমাকে নতুন কাউকে নিয়ে নিতে হবে। আমার অফিসে তো আর বাড়তি লোক নেই।’ সেদিন বাসায় এসে ইকবালকে সব কথা বলতেই সে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, ‘এখন আমাকে এসব বলে কি হবে? আমি তো আগেই বলেছি...।’ মম বসে রইল বারান্দার গ্রিল ধরে। বিষণ্ন। অবসন্ন। বাইরে শীতের তোড়জোড়। দূরের ল্যাম্পোস্টের বাতি ঘিরে কুয়াশার ঘোর। ঘোরের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে মমও। ওর কেবলই মনে হচ্ছিল ইকবালের কথা শোনাই বোধ হয় ঠিক ছিল। কি দরকার ছিল এসব ‘ঝামেলা’ পোহানোর! পরক্ষণেই ভিতর থেকে কেউ একজন বাধা দিয়ে উঠল মমকে। মমর ঘোর কাটল! ছুটি পাশ হলো না। বাড়িতে বসে থাকা মানুষের বেতন দিতে চায় কোন্ অফিস! মম অফিস যাওয়া বন্ধ করে দিল। একদিন হিয়া ফোন করেছিল মমর কাছে, খোঁজ নেওয়ার জন্য। ওর কাছে শুনল মমর জায়গায় নতুন একটা মেয়েকে নিয়ে নেওয়া হয়েছে অফিসে। মম ভারী হয়ে পড়ল অনেক। এখন সংসারের কাজ-কর্মও করতে পারে না। দু’জনার সংসার হলেও কাজ নিতান্ত কম নয়। রান্না-বান্না, ঘর-দোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, জামা-কাপড় কাচা। একজন কাজের লোক রাখতে পারলে ভালো হতো। ইকবালকে বলতেই সে ফুঁসে উঠল, ‘একজনের আয় দিয়ে তো সংসারই চলবে না। তার উপর কাজের লোকের জন্য বাড়তি টাকা কি ভূতে যোগাবে?’ মমর চোখের কোণ ভিজে উঠল, ‘তুমি সব সময় আমার সাথে ওভাবে কথা বলো কেন? যে আসছে সে কি শুধু আমার একার সন্তান? তোমার নয়?’ ‘আমি চেয়েছিলাম সন্তান তোমার কাছে?’ ইকবালের কণ্ঠে বিদ্রুপ। এই ইকবাল একদম অচেনা মমর। এই ইকবাল সেই ইকবাল নয় যে ছুটির দিনে মমকে রিকশা করে শহর দেখাতো, হাতিরঝিলে নীল-আকাশ মেঘের বিকেলে গা ঘেঁষে বসে বাদাম চিবাতো, রঙিন স্বপ্নের জাল বুনতো। এই ইকবাল সেই ইকবাল নয়, কখনোই। কি বলবে আর মম! তারপরও আকুতি করে বললো, ‘তোমার মাকে একটু বলো না হয় এখানে এসে থাকতে ক’টা দিন।’ ‘ছেলে হলেও কথা ছিল। হবে তো মেয়ে। তোমার মেয়ে ধরার জন্য আমার মা আসতে পারবে না।’ বলে অফিসের জন্য বের হয়ে গেল ইকবাল। অনন্যোপায় হয়ে শেষমেষ নিজের মাকে এসে থাকতে বললো মম ওদের সাথে। ওর মা’ও ঝাড়া হাত-পা নয়। তাঁর নিজের সংসার রয়েছে, রয়েছে হাজারও ঘর-গৃহস্থালির কাজ। তাছাড়া মমর বাবার ডায়াবেটিস, তাঁর শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না ইদানীং। মা চলে এলে ওদিকে ভাবী একলা পড়ে যাবে, একা সব দিক কুলিয়ে উঠতে পারবে না। আবার এদিকে প্রথম সন্তানের মা হতে যাচ্ছে মেয়ে। খুব বেশি দিনও তো বাকি নেই! এমন সময় কাউকে না কাউকে অবশ্যই সার্বক্ষণিক তার পাশে থাকা উচিৎ। বলা যায় না কখন কি হয়ে যায়! সব ভেবেচিন্তে মমর মা ঢাকা চলে এলেন, এসে রইলেন মেয়ের সংসারে। মমর মা এসে থাকাতে সংসারের কিছুটা শ্রী ফিরল। ইকবালও গলা উঁচু করে না যখন তখন। বরং যতক্ষণ বাসায় থাকে একটু বাড়তি রকমের গম্ভীর হয়ে থাকে সে। এভাবেই চলছিল দিন। এক সময় মম বুঝতে পারল দিন ঘনিয়ে এসেছে। আল্ট্রাসনোগ্রাম এর রিপোর্ট অনুযায়ী এখন আর দিন নয়, কয়েকঘণ্টার অপেক্ষা। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে মম ইকবালকে বলেছিল, ‘জানো, আমার খুব ভয় হচ্ছে। মনে হচ্ছে আজই কিছু একটা হয়ে যাবে।’ গলায় টাই বাঁধতে বাঁধতে ইকবাল নির্লিপ্ত গলায় বললো, ‘হলে হবে।’ ‘আমাদের প্রথম বেবি আসছে। তুমি আমার সাথে থাকবে না? তুমি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে না?’ মমর গলায় মিনতি। ‘অফিসে ভীষণ কাজের চাপ। আমি কোনভাবেই কামাই করতে পারব না। কি চাও তুমি? তোমার মতো আমিও চাকরিটা হারাই?’ ইকবালের গলায় শ্লেষ। ‘তাই বলে!’ মম কথা শেষ করতে পারল না। ‘তোমার মা তো রয়েছেনই। অবস্থা সে রকম দেখলে একটা সিএনজি ডেকে হাসপাতালে চলে যেও।’ বললো ইকবাল। তারপর বেরিয়ে গেল হনহন করে। মম বুঝতে পারছিল দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে ইকবালের সব কথা শুনেছেন মা। নিজেকে ভীষণ অপমানিত মনে হচ্ছিল তখন। মম যেখানে নিয়মিত দেখায় সে হাসপাতাল ওদের বাসা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। তাই বলে এই সময় এইভাবে কোন মানুষ বলতে পারে! ইকবাল চলে যাওয়ার পরে মা এসে বসলেন মমর পাশে। মম দেয়ালের দিকে মুখ ফিরে শুলো। এ মুখ সে নিজের মাকেও দেখাতে পারবে না। সাড়ে ন’টার দিকে মমর প্রসব বেদনা শুরু হলো। মমর মা নিচে নামলেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিএনজি ডাকলেন। তিন মম চোখ মেলে তাকাল। তিন-চারজন তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাদের সবার পরনে আকাশী রঙের এপ্রোন, মুখে হালকা সবুজ রঙের মাস্ক। ডাক্তার ম্যামকে চিনতে পারল মম। তারপাশে দাঁড়িয়ে আরও কয়েকজন। সবাই নার্স হবে বোধ হয়। ডাক্তার ম্যাম মমর কানের কাছে মুখ এনে জানতে চাইলেন, ‘ব্যথা হচ্ছে?’ মম ঘাড় নাড়ল। শরীরে ব্যথা-বেদনার কোন অনুভূতি এখন তার নেই। মমর মনে হচ্ছে, সে সাঁতার কাটছে। কখনো ডুব-সাঁতার, কখনো চিৎ-সাঁতার। এই একটু আগে সে তলিয়ে গিয়েছিল ঘোলা পানির নিচে, এইমাত্র সে ভেসে উঠেছে। আচমকা আবার তলিয়ে গেল পয়সা তলিয়ে যাওয়ার মতো। ফের ভেসে উঠল, যেভাবে ডোবার পানিতে হঠাৎ ভেসে ওঠে রূপালী পেটের মাছ। তারপর আবার নিকষ কালো অন্ধকার। একটা বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনতে পেল মম। খুব কাছেই। তারপরই আবার সব কিছু নিস্তব্ধ। যেন কানে তালা লেগে যায়। একটুবাদে কয়েকজন মানুষের পায়ের আওয়াজ ভেসে এলো এদিকটায়। তারপর আবার নীরবতা। বাচ্চাটা এখনও কাঁদছে। কেউ বাচ্চাটাকে থামাচ্ছে না কেন! মম অবাক হচ্ছিল। কেউ একজন মমকে হাত দিয়ে নাড়া দিল। ‘এই দেখেন, কী ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে আপনার! এই দেখেন।’ কেউ একজন বললো মমকে। মম ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। ‘ও, মেয়ে!’ মম চোখ বুজল। মা’র মুখটা ভেসে উঠল একবার চোখের সামনে। কোথায় মা? অপারেশন থিয়েটারের বাইরে হবে হয়তো। মা যদি একবার হাতটা রাখতেন ওর মাথার উপরে, ছেলেবেলায় জ্বর হলে যেমন রাখতেন! মম আবার তলিয়ে গেল। ঘোলা জলের নিচে। চার প্রায় পনের ঘণ্টা পরে মমর জ্ঞান ফিরল। প্রথমটায় বুঝতেই পারল না সে কোথায় আছে। দেয়ালে শূন্য পাওয়ারের একটা রঙিন বাতি জ্বলছে। হালকা গতিতে ফ্যান চলছে মাথার উপরে। মমর গলা পর্যন্ত ভারী কাপড়ে ঢাকা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল মম। একটা আবছা মূর্তি বসে রয়েছে তার মাথার কাছে। মমকে নড়তে দেখে আবছা মূর্তিটিও নড়ে উঠল, মাথা নিচু করে এগিয়ে এলো মমর দিকে। ‘মম, মা আমার।’ ডাকলেন মা। মম হাত বাড়িয়ে দিতেই দু’হাতে হাতটা জড়িয়ে ধরলেন। একটু বাদে বাতি জ্বালালেন মা। দেয়ালঘড়িতে রাত দু’টো। মমর পাশে নরম কাপড়ে মোড়া নবজাতক, মমর মেয়ে। মেয়েকে দেখামাত্রই বাস্তবে ফিরল মম। তলপেটের ব্যথাটাও যেন ফিরে এলো। সেই সাথে ফিরে এলো স্মৃতি। মনে পড়ল ইকবালের কথা। ‘মা, ইকবাল কোথায়?’ ‘বাইরে। বসে আছে।’ ‘এখনও বসে আছে! কাল তো ওর ওফিস আছে। ওকে বাসায় যেতে বলো। অফিস থেকে এসে কিছু খেয়েছে?’ ‘ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না তোকে। আমরা একভাবে চালিয়ে নিয়েছি। মেয়েকে দেখবি? রাজকন্যার মতো মেয়ে হয়েছে তোর। দুধের মতো গায়ের রঙ।’ বললেন মা। মম ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করল। কাপড়-চোপড়ের কুণ্ডলীর মধ্যে একটু শব্দ করে কেঁদে উঠল যেন মেয়েটা। ‘ইকবাল কি করেছে জানিস?’ খুশি-খুশি গলায় বললেন মা। মম তাকাল জিজ্ঞাসু চোখে। ‘অফিস থেকে ফেরার সময় রাজ্যের জিনিসপত্র কিনে এনেছে। ল্যাক্টোজেন, ডায়াপার, ওয়েল-ক্লথ। ছোট একটা মশারি কিনে এনেছে। বেবি লোশন, ক্রিম আরও কত কী! সবকিছুর আমি নামও জানি না। এত করে বললাম, বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসতে। কিছুতেই গেল না। বললো তোর সাথে দেখা করে তবে যাবে।’ ‘তুমি ওকে একটু ডাকবে মা!’ বললো মম। মা উঠে চলে গেলেন কেবিনের বাইরে। একটু বাদে ইকবাল ঢুকল। এসে বসল মমর মাথার কাছে। মম একটা হাত বাড়িয়ে দিতেই মাঝপথে হাতটা ধরল। তারপর মমর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে একটা চুমু খেল কপালে। মমর চোখ দিয়ে জল গড়াল। অনেকক্ষণ বসে রইল ইকবাল। মমর হাত ধরে। এক সময় বললো, ‘আব্বা-মা আসছেন রাতের গাড়িতে। বলেছি সোজা হাসপাতালে আসতে। নাতির মুখ দেখে তারপর বাসায় যাবে। ভালো করেছি না?’ ‘হুম।’ বললো মম। একটু হাসার চেষ্টা করল। জিব দিয়ে ঠোঁট চাটল। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। ‘মেয়ের নাম কি রাখবে ঠিক করেছো?’ জানতে চাইল ইকবাল। জন্ম নিয়েই সব কিছু জয় করতে শুরু করেছে এই মেয়ে! এই মেয়ের নাম ‘জয়া’ই থাক। বললো মম মনে মনে। তারপর চোখ বুজল। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে তার। এক সময় ইকবালের হাতটা হাতের মুঠিতে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ল। স্বামী কবিরুল নিরুদ্দেশ হওয়ার সাথে সাথে রুমকির জীবনটা একটা বড়সড় বাঁক নিল। তা না হলে তার জীবনের গল্পটা হতে পারত অন্যরকম। শ্রাবণের সেই সকালে নারায়ণগঞ্জের ওদিক থেকে ভারী কিছু মেঘ ভেসে এসেছিল রুমকিদের আকাশে। ওদের দেড়রুমের ছোট্ট ভাড়া-বাসাটার টিন-চালের উপর টপাটপ শব্দ তুলে অঝোরে ঝরল কিছুক্ষণ শ্যামবর্ণের ডাগর মেঘগুলো, তারপর কিছুটা ডানা হালকা করে ভাসতে ভাসতে চলে গেল সোজা পশ্চিমে। তখনও রেশম-গুঁড়োর মতো প্রায় ভরহীন বৃষ্টির কণা ঝরছে আকাশ থেকে। দু’পায়ের ফাঁকে কোলবালিশ নিয়ে চোখ বুজে পড়ে ছিল কবিরুল। পাশেই তাদের চার বছরের ছেলে রাহাত, ভেজা বৃষ্টির শীত-শীত সকালে চারহাত-পা এক করে গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে, বালিশটা পড়ে রয়েছে তার মাথা থেকে হাতখানেক দূরে। লাগোয়া একচিলতে রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে গলা তুলল রুমকি, শাড়ীর আঁচল কোমরে জড়ানো তার, এক হাতে হলদেটে আগা খুন্তি, ‘কি গো, তোমার ডিউটি নাই? অখনও ঘুমাও যে!’ ‘উঁহু, ডিউটি নাই।’ ঘুমের দেশ থেকে বললো কবিরুল। এক সাহেবের গাড়ি চালায় কবিরুল। মস্তবড় অফিসে সে সাহেবের কাজ, সপ্তাহে ছুটি পান একদিন, শুধু শুক্রবার। কবিরুলেরও সপ্তাহে ছুটি সেই একদিন-ই। কিন্তু আজ তো সোমবার! কবিরুলের কথা শুনে রুমকি তাই একটু অবাক হলো, ‘ক্যান, ডিউটি নাই ক্যান আইজকা?’ ‘ছুটি লইছি। ইয়ারপোর্ট যামু। মামুনরে আনতে।’ কোলবালিশ আঁকড়ে ধরল কবিরুল। মামুন কবিরুলের ছোটবেলার বন্ধু। দুবাই থাকে, শ্রমিকের কাজ করে সেখানে, বছর পাঁচেক বাদে দেশে ফিরছে। কিভাবে কিভাবে যেন সে কবিরুলের মোবাইল নম্বর যোগাড় করে ক’দিন আগে কবিরুলকে ফোন করে জানিয়েছে এ কথা। সেই থেকে কবিরুলের নাওয়া-খাওয়া নেই। উঠতে-বসতে, চলতে-ফিরতে মামুন মামুন করে মাথা ধরাচ্ছে। জানো রুমু, মামুন দেশে আসতাছে। জানোই তো, ঢাকায় আমি ছাড়া ওর আর কেউ নাই। তাই আমারেই যাইতে বলতাছে ইয়ারপোর্টে, আনতে। বোঝোই তো, কুটি কালের বন্ধু, আমি না গেলে কেমন দেখায়। সেদিন জিগাইতেছিল আমার জন্য কিছু আনতে হইব কি না। আমি কইছি কিচ্ছু আননের দরকার নাই। আগে ভালোই ভালোই তুই ফিইরা আই, তারপর দেখা যাইব। রুমকি শোনে, চুপ করে থাকে, ফাঁকে-ফাঁকে হাঁ-হু করে। কিন্তু মামুন যে আজই দেশে ফিরছে তা জানা ছিল না রুমকির। এখন শুনে একটু অবাক হলো, রাগ হলো স্বামীর উপর। বন্ধু আসছে বিদেশ থেকে তাই তাকে আনার জন্য ডিউটি কামাই করতে হবে? যত সব আদিখ্যেতা! সাহেবের অফিস যেতে কত কষ্টই না হবে আজকে। এগারোটার দিকে বিছানা ছাড়ল কবিরুল। উঠেই বাথরুমে ঢুকল, দুমদাম করে এক বালতি পানি মাথায় ঢালল, তারপর বেরিয়ে এসে এক প্লেট সবজি-ডাল-গরমভাত ঢালল গলায়- যেন একবস্তা ধান উপুড় করে ফেলল রাইচমিলের হলারের উপর। ইস্তিরি করা সাদা জামা গায়ে চাপিয়ে একটু বাদে ফুলবাবুটি সেজে বের হয়ে গেল। যাওয়ার আগে রুমকিকে বললো, ‘আমার ফিরতে একটু দেরী হইতে পারে। মামুনরে ট্রেনে তুইলা দিয়া তারপর আসুম।’ রাহাত তখন ঘুম থেকে সবে উঠেছে, খেলছে দু’দিন আগে বাবার কিনে দেওয়া চাবি-দেওয়া গাড়িটা নিয়ে। তাকে কিছু বললো না কবিরুল যাওয়ার সময়, চলে গেল ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে। টুকটাক কাজে ডুবে ছিল রুমকি দুপুর পর্যন্ত। কবিরুলের কথা মনে পড়েনি অতটা। দুপুরের পর একবার মোবাইল বাজল, রুমকি দৌড়ে গিয়ে ধরতেই ওপাশ থেকে ঢোক গিলে গিলে বললো কবিরুল, ‘রুমু, মামুন কিছুতেই ছাড়তেছে না। বলতেছে ওর সাথে বাড়িত্ যাইতে। যামু?’ রুমকি বললো না কিছু, ফোন কানে ধরে রইল কিছুক্ষণ। এপাশের নীরবতায় একটু সাহস পেল কবিরুল। বললো, ‘একটুও চিন্তা কইরো না। আমি ওরে গ্রামে পৌঁছায়া দিয়াই ফিরতি ট্রেনে ঢাকা ফিরুম।’ আগুন ধরে গেল রুমকির মাথায়। যেন জলন্ত দেশলাই কাঠি থেকে আগুন ধরল গ্যাসের চুলোয়। আঙুলের আগা দিয়ে টিপে ধরল মোবাইলের কল কাটার বোতামটা। ফোনের একপাশে তখন প্রিয় বন্ধুকে কাছে পেয়ে প্রগলভ কবিরুল, অন্যপাশে জ্বলজ্বলে আগুনের ফুলকি রুমকি। তারপর দু’দিন হয়ে গেল, কবিরুলের আর কোন খোঁজ নেই। মানুষটা এত বড় কাণ্ডজ্ঞানহীন নয়। নয় এতটা পাষাণও। ছেলেকে না দেখে থাকতে পারে না দু’দণ্ড, দু’দিন তো ভাবনারও বাইর। তাছাড়া সে বুঝতে পেরেছে রুমকি তার উপর রাগ করেছে। সচরাচর এ রকম হলে সে বার বার রুমকিকে ফোন করে, এটা ওটা বলে বৌয়ের মান ভাঙাতে চায়। এ দু’দিনে সে রকম কিছুও করেনি কবিরুল! মনের ভিতর তাই কু ডাকতে শুরু করল রুমকির। তবে কি তার কোন বিপদ হলো! দু’দিনের জমানো অভিমান আর ক্ষোভের বহ্নিশিখা এখন নিভে এসেছে অনেকটাই। কিন্তু পোড়া ক্ষতটা জ্বলছে আগের মতোই, রুমকির বুকের চিতায়। ফাঁকে ফাঁকে নানা আশঙ্কার লকলকে জিহবা উঁকি দিয়ে যাচ্ছে মনের ঘরে, বিষাক্ত সাপের জিব যে রকম উঁকি দেয়। সেদিন দু’পুরে খাওয়ার পর রাহাত জিজ্ঞেস করল, ‘মা, বাবায় কখন আসব?’ ‘জানি না তোর বাপে কখন আসব।’ ঝাঁজ মেখেই বললো রুমকি। ‘বলো না মা, বলো না। বাবায় কখন আসব?’ মায়ের শরীরের দিকে এলোমেলো হাত-পা ছুড়তে লাগল রাহাত। ‘সন্ধ্যায় আসব। অখন ঘুমা।’ ধমক দিয়ে ছেলেকে থামাল রুমকি। মায়ের ধমক খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল রাহাত। উঠল সন্ধ্যার একটু আগে। কিছুক্ষণ খেলল খেলনা গাড়িটা নিয়ে। সন্ধ্যা উতরালে রুমকি তাকে নিয়ে বসল প্রতিদিনের মতো, হাতে বর্ণমালার বই। তখনই আবার বাবার কথা মনে পড়ে গেল রাহাতের, বলে উঠল, ‘মা, তুমি না কইছো, বাবায় সন্ধ্যাকালে আসব! বাবায় আসে না ক্যান? বাবায় কখন আসব?’ ‘একটু বাদে আসব বা’জান। তুমি পড়তে বসো।’ এবার আর গলায় অতটা জোর পেল না রুমকি। ‘বাবায় না আসলে আমি পড়তে বসমুনা। বসমু না।’ জেদ ধরল রাহাত, কাঁদতে আরম্ভ করল জোরে জোরে। রুমকি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাল, কষে চড় বসাল ছেলের গালে। মার খেয়ে কান্নার তোড় আর শব্দের তীব্রতা দু’টোই বাড়ল। ছেলের কান্না থামানোর আর কোন উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়েই মোবাইল হাতে নিল রুমকি, ফোন করল কবিরুলের নম্বরে। তখনই আবিষ্কার করল কবিরুলের মোবাইল বন্ধ! সে-রাতে কিছু খেল না রাহাত, কাঁদতে কাঁদতেই এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু রুমকির ঘুম এলো না কিছুতেই। এর মধ্যে কবিরুলের মোবাইলে চেষ্টা করল রুমকি অনেকবার। কিন্তু সেই একই যান্ত্রিক শব্দ, কল ঢুকল না কিছুতেই। কত কিছু যে মনে হতে লাগল রুমকির! একবার মনে হলো রাগ করে সে সেদিন ফোনের লাইন কেটে দিয়েছিল বলে হয়তো কবিরুল এখন ইচ্ছে করে নিজের মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে তাকে ‘মজা’ দেখানোর জন্য। আবার একটু বাদে মনে হলো হয়তো মোবাইলের চার্জ ফুরিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে, ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সে এখন তাকে ফোন করতে পারছে না। পরক্ষণেই আবার মন ছুটল উল্টোপথে। ঠিক আছে বোঝা গেল চার্জ নেই বলে মোবাইল বন্ধ, তাই বলে কি একটা ফোন করার আর কোন উপায় নেই? ফোন করার কত কত দোকান থাকে পথে-ঘাটে, রেলস্টেশনে, সেখান থেকেও তো একটা ফোন করা যায়। এমন তো না যে রুমকির নম্বর তার মুখস্ত নেই। নাকি বাল্যবন্ধুকে পেয়ে আহলাদে আত্মহারা হয়ে বৌয়ের মোবাইল নাম্বারটাও ভুলে বসে আছে! সে-রাতটা শেষ হচ্ছিল না কিছুতেই। মাঝে মাঝে চোখ লেগে আসছিল রুমকির, কিন্তু তন্দ্রার সুতো কাটছিল আচমকা ধেয়ে আসা কোন সূক্ষ্ম শব্দেও। বারবার বালিশ থেকে মাথা উঁচু করে কান খাঁড়া করে শুনছিল দরজায় কারও টোকা পড়ল কি না! পরের দিন দুপুরের পরপর একজন ভদ্রলোক এলেন রুমকিদের বাড়ির সামনে। রাহাত তখন ঘুমিয়ে। মুখে আঁচল টেনে ঘরের দরজায় দাঁড়াল রুমকি। আগন্তুকের ফর্সা চেহারা তেতে লাল, বিন্দু বিন্দু ঘাম কপালে, কবিরুলের বাসা অব্দি আসতে তাকে মেলা কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে বোঝা যায় অল্পতেই। রুমকিকে দেখে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে কবিরুল থাকে?’ ‘জি।’ বললো রুমকি। ‘আপনি কবিরুলের…?’ জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন ভদ্রলোক। ‘জি, আমি তার ইস্তীরি।’ বললো রুমকি। ‘দু’দিন ধরে সে ডিউটিতে যাচ্ছে না। মোবাইলও বন্ধ। তাই খোঁজ নিতে এলাম। কি হয়েছে কবিরুলের?’ ভদ্রলোক জানতে চাইলেন। ‘আমারও জানা নাই তার খবর। বন্ধুরে নিয়া গ্রামের বাড়িত গি’ছিল। আসার কথা ছিল পরদিনই। কিন্তুক আজ তিনদিন তার কুনো খোঁজ নাই। মোবাইলডাও বন্দ।’ ভদ্রলোককে দেখে খুশি হয়ে উঠেছিল রুমকি, এক মুহূর্তের জন্য আশার সঞ্চার হয়েছিল হয়তো তাঁর কাছ থেকে কবিরুলের কোন সংবাদ পাওয়া যাবে। এখন জানা গেল, যিনি এসেছেন তিনি সংবাদ নিতে এসেছেন, দিতে নয়। তাই আশার বেলুন চুপসে গেল রুমকির। ‘ওর আত্মীয়-স্বজন কারো মোবাইল নম্বর আছে আপনার কাছে? কারো কাছে খোঁজ নিয়েছেন?’ সাহেবকে একটু চিন্তিত দেখাল। ‘তিনকুলে ওর কেউ নাই। এর গ্যারেজে, ওর গ্যারেজে কাম কইরা মানুষ হইছে। তাগো কাউরে তো আমি চিনি না।’ ভাত ফোটার গরগরে কণ্ঠে একদমে রুমকি বললো কথাগুলো। রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছলেন সাহেব, কথা হাতড়াতে হাতড়াতে বললেন, ‘আপনার কাছে নগদ টাকা পয়সা কিছু আছে? বলতে একদম সংকোচ করবেন না।’ যা ছিল তা তো শেষ এই ক’দিনেই। তবুও কিভাবে বলা যায় সে কথা মুখ ফুটে! বলতে সংকোচ হচ্ছিল খুব। চুপ করে রইল রুমকি। একটা পাঁচশ টাকার নোট বাড়িয়ে ধরলেন সাহেব রুমকির দিকে। হাত বাড়িয়ে নোটটা নিল রুমকি। মানিব্যাগ থেকে চকচকে শক্ত এক টুকরা চারকোণা কাগজ বের করে তার পিছনে খস করে কিছু লিখে এগিয়ে দিলেন সাহেব রুমকির দিকে, ‘এটা আমার কার্ড। এখানে আমার নাম ঠিকানা লেখা আছে। বাসার ঠিকানাও লিখে দিলাম। দরকার হলে যোগাযোগ করবেন। আর কবিরুল ফিরে এলে আমাকে ফোন করতে বলবেন।’ মাথা নাড়ল রুমকি, হাত বাড়িয়ে কার্ডটি নিল। সাহেব চলে গেলেন কিছুটা দুশ্চিন্তা, কিছুটা বিরক্তি আর কিছুটা হতাশা নিয়ে। দিন এগোয়, রাত পেরোয়, সময় পিছনে পড়ে। রুমকির জীবননাট্যে কবিরুল চরিত্রটি থেকে যায় অনুপস্থিত, কালো পর্দার আড়ালে। তাকে ঘিরে পুরোনো স্মৃতিরাই যা নোঙ্গর ফেলে বসে থাকে মনের বন্দরে, নতুন স্মৃতি জন্মায় না। কবিরুল ফিরে আসে না। তার মোবাইলও চালু পাওয়া যায় না আর। হতে পারে ছোট বাচ্চাদের ভিতরে কিছু বোধশক্তি কাজ করে। সে বোধশক্তি ব্যবহার করে পরিস্থিতিও বিচার করতে পারে তারা তাদের মতো করে। বাবার কথা জিজ্ঞেস করে প্রত্যুত্তরে শুধু মায়ের চোখে জলের প্লাবন দেখে রাহাত যা বোঝার বুঝে নিয়েছে এ ক’দিনে। সারাদিনে সে আর এখন বাবার কথা জিজ্ঞেস করে না। কিন্তু রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় বাবার কথা না বলেও পারে না। এই সপ্তাহখানেক আগেও সারাদিন খাটাখাটনি করে রাতে বাসায় ফিরে খাওয়া-দাওয়ার পর বাবা তার শুয়ে থাকত টানটান হয়ে। সে সময় বাবার পেটের উপর বসে তার লোমশ বুকের উপর ছোট্ট খেলনা গাড়িটা চালাত রাহাত। মুখ দিয়ে ইঞ্জিনের শব্দ করত। হর্ণ বাজাত। গাড়ি চালিয়ে চালিয়ে ক্লান্ত হতো এক সময়, ঠিক তার বাবার মতো। তারপর এক বুক ক্লান্তি নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ত বাবার বুকের উপর। এখন বাবা নেই। খেলনা গাড়িটা চালাতে আগ্রহ পায় না রাহাত। ক্লান্তিরা ঘিরে ধরে না এখন ছোট্ট ছেলেটিকে, দু’চোখে লুটোপুটি খায় না ঘুমেরাও। মেলা রাত পর্যন্ত রাহাত তাই এখন জেগেই থাকে। এমন দুঃসময়ে কাছে পাবার মতো রুমকির কেউ নেই এই শহরে। মা মারা যাওয়ার পরে সৎ মায়ের সংসারে তিষ্ঠাতে না পেরে সেই কবে লঞ্চে চেপেছিল রুমকি! ঢাকায় এসে এক গার্মেন্টে কাজ নিয়েছিল। সে কাজ ছেড়েছে সে মেলাদিন আগে, বলতে গেলে কবিরুলের সাথে বিয়ে হওয়ার পরপরই। পুরাতন গার্মেন্ট-সহকর্মী যারা এক সময় ছিল সুখ-দুঃখের সাথী তাদের সাথে আজ আর কোন যোগাযোগই অবশিষ্ট নেই। কেরানীগঞ্জের ওদিকে ওরা থাকত তখন। সেই সব সঙ্গী-সাথীরা হয়তো এখন আর থাকে না সেখানে, আর থাকলেও হয়তো তারা চিনতে পারবে না রুমকিকে। রুমকিও পথঘাট চিনে পৌঁছাতে পারবে না সেখানে এখন আর। এ শহরে পথেরা নিত্য রূপ বদলায়। চিনে উঠতে উঠতে ফের হয়ে ওঠে অচেনা। আর এ পথে তো পা-ই পড়ে নি বহুদিন হয়, চিনে রাখার চেষ্টাও ছিল না রুমকির সদ্য অতীত হওয়া দিনগুলোতে! দিনদশেক কাটাল রুমকি পথ পানে চেয়েই। তারপর একদিন সাহেবের দেওয়া কার্ডটা হাতে করে রাহাতকে সাথে নিয়ে চলল মালিবাগের দিকে। খুঁজে-টুজে বের করল সাহেবের বাসা। বাসার সিকিউরিটি কবিরুলকে চিনত। নিপাট ভালো লোক বলে জানত সে কবিরুলকে। এমন একজন ভালো মানুষের হঠাৎ তিরোধানে সেও ভীষণ মর্মাহত- জানাল রুমকিকে কথায় কথায়। আরও বললো, সাহেব এখন বাসায় নেই, সকালে দৌড়েছেন অফিসে। সে তাই ইন্টারকমে মেমসাহেবের সাথে কথা বললো, তাকে জানাল কবিরুলের স্ত্রী রুমকির আগমনের কথা। অনুমতি মিলল। রুমকি রাহাতকে সাথে নিয়ে ঢুকল সাহেবের ফ্ল্যাটে। মেমসাহেব বললেন, ‘সাহেবের অফিসে যেতে হয় প্রতিদিন। আর কতদিন তিনি কবিরুলের পথ চেয়ে থাকবেন! তাই নতুন ড্রাইভার নেওয়া হয়েছে।’ রুমকি লম্বা শ্বাস ফেলল। কবিরুলের হঠাৎ নিরুদ্দেশে হা-হুতাশ ঝরল মেমসাহেবের কথায়। এক ফাঁকে ফ্রিজ থেকে বের করে মিষ্টি খেতে দিল রাহাতকে। খাবার টেবিলের উপর রাখা ফলমূলের গাদা থেকে একটা আপেল আর একটা কমলা তুলে দিল রাহাতের হাতে। জোর করে এটা ওটা খাওয়াল রুমকিকেও। রুমকির কিছুই নামছিল না গলা দিয়ে। কি সুন্দর ফুটফুটে একটা বাচ্চা রয়েছে সাহেবদের! দামী খেলনা নিয়ে খেলছে তো খেলছেই, চুপচাপ, টিভির সামনে বসে। রাহাতের চেয়ে বয়সে কিছুটা ছোটই হবে। কিন্তু এ বয়সেই ইংলিশ স্কুলে যায়, কথায় কথায় বললো মেমসাহেব। রুমকি যখন চলে আসছিল তখন মেমসাহেব জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাদের এখন চলছে কিভাবে?’ চুপ করে রইল রুমকি। ছেলেকে নিয়ে বেঁচে আছে- আধপেটা খেয়ে, না খেয়ে। ক্ষুধা, আশঙ্কা আর অনিশ্চয়তার মেঘ সারাক্ষণ মাথার উপরে, আকাশ কাঁপিয়ে ডাকছে সব সময়। এটাকে কি চলা বলে! হয়তো বলে। রুমকির হাতে পাঁচশ টাকার একটা নোট দিল মেমসাহেব। হাত পেতে সেটা নেওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না রুমকির। ‘এখন কি করবে ঠিক করেছ?’ জানতে চাইল মেমসাহেব। ‘ভাবতাছি কারো বাসা-বাড়িত কাম নিমু।’ বললো রুমকি। কি যেন ভাবলেন মেমসাহেব, ‘সামনের মাস থেকে আমি একজন কাজের লোক রাখব ঠিক করেছি।’ একটু থামল, বলবে কি বলবে না একটু দোনামনা করছিল বোধ হয়, শেষ পর্যন্ত বলেই ফেলল, ‘দীপ্তকে স্কুলে দিয়েছি ক’দিন হলো। তোমার সাহেবের সময় নেই। তাই আমিই নিয়ে যাই ওকে সকালে, ঘণ্টাদু’য়েক থাকতে হয় সেখানে আমায়। তারপর বাসায় এসে ঘোর-দোর গোছানো, রান্না-বান্না করা, জামা-কাপড় পরিষ্কার করা খুব কঠিন হয়ে যায়, সময় মেলাতে পারি না। তাই ভাবছি একটা কাজের লোক রেখে দেব। ইচ্ছে করলে… ইচ্ছে করলে তুমি আমার বাসায় কাজ করতে পার। আমাদের ছোট সংসার, কাজ কর্ম বেশি একটা নেই।’ সময় নেওয়াটা তখন বিলাসিতা-ই মনে হচ্ছিল রুমকির কাছে, যেটা তার সামর্থ্যের একেবারেই বাইরে। খুব দ্রুতই সিদ্ধান্তটা নিয়ে নিল তাই সে। তৎক্ষণাৎ হ্যাঁ বলে দিল, সাহেবের বাসায় ঠিকে-ঝিয়ের কাজে লেগে গেল পরদিন থেকেই। কবিরুল থাকাকালীন সময়ে রুমকিরা যে বাসাটিতে ভাড়া থাকত তার ভাড়া ছিল মাসে পঁচিশশ’ টাকা। এখন কবিরুল নেই, আয়-রোজগারও নেই। তাই বাসাটা ছেড়ে দিল রুমকি। আবার যেকোন দিন কবিরুল ফিরে আসতে পারে, আর এসেই হয়তো খুঁজবে ওদের পুরোনো বাসাতেই, এই ভেবে পুরোপুরি এলাকা ছেড়ে যেতে পারল না। আগের বাসাটার সামান্য দূরে বস্তির মধ্যে একটা খুপরি ঘর ভাড়া নিল রুমকি, মাসিক নয়শ’ টাকা ভাড়ায়। সেখান থেকে কাজে যেতে লাগল প্রতিদিন সাহেবের বাসায়। রাহাতও তার সাথে যায়। রুমকির রোজনামা মোটামুটি একই রকমের। সকাল ন’টার দিকে সাহেবের বাড়িতে যায় সে। একটু বাদে দীপ্তকে নিয়ে চলে যায় মেমসাহেব। সেই ফাঁকে কিছু কাজ এগিয়ে রাখে রুমকি। স্কুল থেকে ফিরে এসে সাজ-পোষাক বদলে রান্নায় হাত দেয় মেমসাহেব, রুমকি তখন এটা ওটা এগিয়ে দেয় তাকে। এক ঘর খেলনা দীপ্তর। সেগুলো নিয়ে রাহাত খেলে দীপ্তর সাথে। প্রায় সময় দু’জন মিলেমিশে খেলে, মাঝে মাঝে ঝগড়া বেধে যায় দু’জনের মধ্যে, তখন রুমকি দৌড়ে গিয়ে থামায়। প্রায় চারমাস হয়ে গেছে কবিরুল নিখোঁজ। এখন মাঝে মাঝেই রুমকির মনে হয় কবিরুল আর ফিরে আসবে না কোনদিন। ঢাকা ফেরার পথে হয়তো কোন দুর্বৃত্তের হাতে সে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে, লাশটা দাফন হয়ে গেছে বেওয়ারিশ হিসাবে- এ রকম নির্দয় আশঙ্কারাও হায়েনার মতো হানা দেয় রুমকির মনে, যদিও রুমকি সেগুলোকে মনের ঘরে বাসা বাঁধতে দেয় না কখনোই। এক শুক্রবারের কথা। সাহেব মুখ গুঁজে ছিলেন কম্পিউটারে। ছুটির দিনে রান্না হয় বেশি পদের। রুমকি ছিল মেমসাহেবের সাথে, রান্নাঘরে। অগ্রহায়ণের দিন, রোদের তাপ একটু কমেছে, তবুও দু’জনই ঘেমে নেয়ে অস্থির চুলোর পিঠে। ভীষণ তাড়াহুড়ো দু’জনেরই- ডানে-বায়ে তাকানোর সময় নেই একদম। এমন সময় গলা ফাটানো চিৎকার ভেসে আসল দীপ্তর, ওদিককার ঘর থেকে- যে-ঘরটিতে রাহাত আর দীপ্ত খেলছে। রুমকি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল সেদিকে। গিয়ে দেখল রাহাতের হাতে একটা চকোলেটের খোসা, মুঠি শক্ত করে সে সেটাকে ধরে রেখেছে, আর দীপ্ত সেটা ওর কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইছে। দীপ্ত শারীরিক শক্তিতে কোনমতেই পারছে না রাহাতের সাথে, তাই চিৎকার করছে, যেকোন মূল্যেই সে ঐ মূল্যহীন খোসাটা পেতে চায়। রুমকি গিয়েই ছেলের কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইল খোসাটা। ছেলেও জেদ ধরে আছে, কিছুতেই হাতছাড়া করবে না সে ওটা। অবস্থা বেগতিক দেখে ছেলের পিঠে দুম করে কিল বসিয়ে দিল রুমকি। কিল খেয়ে রাহাত চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। রুমকি জোর করে তার কাছ থেকে চকোলেটের খোসাটা কেড়ে নিয়ে মেমসাহেবের ছেলে দীপ্তর হাতে দিল। এখন দীপ্তও সেটা নেবে না। সে সমানে কেঁদেই চলেছে। ততক্ষণে মেমসাহেবও চলে এসেছে, ‘খালি জেদ’, বলেই চড় কসাল দীপ্তর গালে। সাহেব বেরিয়ে এলেন কম্পিউটার ফেলে, মেমসাহেবকে বললেন, ‘তুমি ছেলের গায়ে হাত তুললে কেন?’ মুহূর্তেই সারা বাড়ি রূপ নিল জলন্ত উনুনে। ছেলেকে টানতে টানতে রুমকি নিয়ে চলে গেল রান্নাঘরের এক কোণায়। লজ্জায় আর ভয়ে বাতাসে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল তখন রুমকির। কোনভাবে ছেলেকে নিয়ে অশরীরী হয়ে যেতে পারত যদি সে তক্ষুণি! এক সময় দীপ্তর কান্না থামল। সাহেব মেমসাহেবও যার যার নিজের কাজে গেলেন। কিন্তু দু’জনেরই মুখ থমথমে। যেন যেকোন সময় বড়সড় ঝড় উঠবে! সেদিন জুমআ’র নামায পড়ে বাসায় এসে সাহেব স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, ‘রাহাতকে সাথে নিয়ে আসা চলবে না কিছুতেই। এ বাসায় কাজ রাখতে চাইলে রুমকিকে একাই আসতে হবে কাল থেকে।’ রুমকির চোখে আঁধার ঘনাল। এক রত্তি ছেলে তার। কোথায়, কার কাছে রেখে আসবে সে তাকে! ওই খুপরি ঘরে ছোট্ট ছেলেটাকে একা রেখে আসার কথা সে ভাবতেই পারে না। মেমসাহেবের হাতে পায়ে ধরল রুমকি খুব করে। কিন্তু মেমসাহেব কোন কথা বললো না। সেদিন সন্ধ্যার পরে একটু আগে-ভাগেই ঘরে ফিরতে পারল রুমকি। মনটা ভালো ছিল না। রাহাতের মনটাও ভেজা ভেজা। তার বুঝতে বাকি নেই বড় সড় কিছু একটা গোল বেঁধেছে। এটাও বুঝতে পেরেছে, গোলটা তাকে নিয়েই। ঘরে ফিরে তেল চিটটিটে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল রাহাত। দুপুরবেলা ছেলেকে মেরেছে রুমকি, সে কারণে ভীষণ অনুশোচনা হচ্ছিল রুমকির। ছেলের পাশে বসে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল, কপালে চুমু খেল কয়েকটা। মায়ের আদরে ছেলের মন আরও নরম হলো যেন, দু’চোখ বেয়ে নামল জলপ্রপাত ‘মা, বাবায় আর আসব না, তাই না?’ ‘আসব বা’জান, আসব।’ বলতে বলতেই চোখ ভিজল রুমকিরও। ‘বাবায় আইলে বাবারে কমু আমারে চকলেট কিনে দিতে। বাবায় কিইন্যা দিব না মা?’ ‘হ বা’জান, দিব।’ বলে ছেলের কপালের উপর থুতনি রাখল রুমকি। রাহাত চোখ বুজল। একটু বাদেই ঘুমিয়ে পড়ল ছেলেটা। রাহাতের মাথা বালিশে সোজা করে দিয়ে হাত-পা টেনে ঠিকঠাক করে দিতে গিয়ে টের পেল ছেলের হাতের মুঠিতে কিছু একটা শক্ত করে ধরা। মুঠি আলগা করতেই বেরিয়ে এলো দুপুরের সমস্ত গণ্ডগোলের মূল সেই চকোলেটের চকচকে খোসাটা! একটা দীর্ঘশ্বাস বের হলো রুমকির বুক ফুঁড়ে, সেই সাথে এলো বুক কাঁপিয়ে কান্না। আহা, তার সোনাটা! তার আদরের মানিকটা! খুব ভালো ছিল না রুমকিরা কখনোই। কিন্তু স্বস্তিতে ছিল। অভাব বলতে ছিল না কিছুই। মন-মেজাজ ভালো থাকলে, বেতনের টাকা পেলে কবিরুল ছেলের জন্য খেলনা কিনে আনত। কিনে আনত আইসক্রিম, চকোলেট। অথচ এখন! কতদিন হয়ে গেল ছেলেটাকে একটা খেলনা কিনে দিতে পারেনি রুমকি। ছেলেটা এটা ওঠা খেতে চায়। কিছুই কিনে দিতে পারে না তাকে। এই চারমাসে নিজের দিকেও তাকায়নি রুমকি। আগের চেয়ে মনে হয় সে একটু শুকিয়েছে, ব্লাউজটা ঢিল ঢিল লাগে ইদানীং। সেদিন মেমসাহেবের আয়নায় নিজের মুখ দেখে ভীষণ চমকে উঠেছিল রুমকি। চোখদু’টো কোটরে, মুখ শুকিয়ে কাঠ। যে ক’টা টাকা পায় সে ঠিকে-ঝিয়ের কাজ করে তার অনেকটাই চলে যায় ঘর ভাড়া দিতে। বাকি টাকা খেয়ে না খেয়ে জমাচ্ছে রুমকি। কবিরুলের খুব শখ ছিল ছেলেকে ‘কিন্ডারগার্ডেন’ স্কুলে পড়াবে। এখন কবিরুল নেই। কিন্তু স্বপ্নটা এখনও ‘নেই’ হয়ে যায়নি। রুমকি এগোচ্ছিলও ঠিক পথে। কিন্তু কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল আজ! এখন কি করবে রুমকি? রাহাতকে কার কাছে রেখে যাবে সে কাজে যাওয়ার সময? সারাদিন কিভাবে একা একা থাকবে ছোট্ট ছেলেটা এই খুপরি ঘরে! এমনিতে সাহেব খুব নরম মানুষ। কিন্তু একবার ‘না’ বললে না, কিছুতেই ‘হ্যাঁ’ বলানো যাবে না। কি হবে এখন! মেমসাহেবের বাসার কাজটা ছেড়ে দেবে? এত ভালো একটা কাজ! কতক্ষণ শুয়েছিল রুমকি বলতে পারবে না। একটু চোখ লেগে গিয়েছিল। হঠাৎ-ই জড়ানো গলায় উড়ে আসা হিন্দী গানের কলি চোখের ঘুম তাড়াল। রুমকি শুনতে পেল টলমল পায়ে কারও পথ মাড়ানোর শব্দ। নিশ্চয়ই হায়দার! এই বস্তির রাজা সে, খান-বিশেক খুপরির মালিক, সব ভাড়া দেওয়া, অধিকাংশই গার্মেন্টের মেয়েদের কাছে। খুপড়িগুলোর মধ্যে যারা থাকে তাদেরও মালিক হায়দার! গলা পর্যন্ত বাংলা মদ গিলে প্রতিরাতে দশটা-এগারোটার দিকে বস্তিতে আসে। কখনো ভাড়া নিতে, কখনো অন্য কিছু। রুমকি অন্য কিছু চাইবার সুযোগ দেয় না কখনোই, প্রতিমাসে আগে-ভাগেই ঘর-ভাড়া শোধ করে দেয়। রুমকির হাত থেকে টাকা নেওয়ার সময় শকুনের মতো তাকায় হায়দার। শাড়ীর আঁচল টেনে ছেড়া ব্লাউজ ঢাকে রুমকি। চোখের পলকে ফুঁ দিয়ে বাতি নিভিয়ে দিল রুমকি। হায়দারের পায়ের শব্দ এসে থামল রুমকির খুপরির দরজায়। গুনগুন করে গাইছে হায়দার, ‘মুন্নি বদনাম হুয়ি…।’ মৃদু ধাক্কা দেয় সে রুমকির চাঁচের দরজায়। যেন একটা ভল্লুক থাবার মধ্যে নখ গুটিয়ে শব্দহীন এগোয় শিকারের দিকে। রুমকি নিশ্বাস বন্ধ করে পড়ে থাকে লাশ হয়ে। ভল্লুকটা দরজা ভেঙে ভিতরে এসে শ্বাস-প্রশ্বাসহীন রুমকিকে মৃত ভেবে ফেলে রেখে চলে যাবে অন্য কোন খুপরিতে, অন্য শিকারের ধান্দায়- এই আশায়। দরজার উপর চাপ বাড়তে থাকে ক্রমশ। ভল্লুকটা কি আজ একটু বেশিই ক্ষুধার্ত! অঘ্রানের শীত-শীত রাতেও ঘামতে থাকে রুমকি। তার শরীর লেপ্টে যায় স্যাঁতসেঁতে বিছানায়। কৃষ্ণপক্ষের আঁধার চুইয়ে চুইয়ে ঢোকে রুমকির ঘরে। এক সময় জমাট অন্ধকার গ্রাস করে নেয় পুরোটা ঘর। ৪ শরীরটা পড়ে আছে খাটের ওপর। কি আশ্চর্য, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি,সম্পুর্ণ নিস্পন্দ,আধবোজা চোখ, মুখটা সামান্য ফাঁক। কয়েক মুহূর্ত আগেই প্রচন্ড যন্ত্রণায় ছটফট করছিল এই দেহ,আর এখন সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন।আমি কেমন করে যেন বেরিয়ে পড়েছি ঐ বদ্ধ খাঁচাটা থেকে,এখন জানলার গ্রিলের কাছটায় ভাসছি।হ্যাঁ,ভাসছিই তো।কারণ,কোন ভর অনুভূত হচ্ছে না আমার,কেমন যেন পালকের মত,অথবা তার চেয়েও সূক্ষ। ঠিক বেরিয়ে আসার মুহূর্তটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না।তবে তার আগের মুহূর্তেও শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল প্রচন্ড,আর এখন শ্বাস নেওয়ার চেষ্টাও করতে হচ্ছে না কোন,বাতাস যেন আমাকে আলিঙ্গন করে রেখেছে,অথবা,যেন আমিই মিশে গেছি বাতাসে।দুলছি,ভাসছি।ভাসতে ভাসতে এগিয়ে গেলাম ঐ পড়ে থাকা শরীরটার কাছে।আমার প্রিয় শরীর।কত যত্নে,কত আবদারে ধরে রেখেছিলাম প্রতিটি শিরা-উপশিরায় সংবেদন, উপলব্ধি,স্পর্শ,অনুভুতি,ব্যাধি।এক মুহূর্তের তফাৎ,সম্পূর্ণ মুক্ত আমি! আঁধারবিহীন আমি এখনও পৃথিবীর বায়ুস্তর ভেদ করে এগিয়ে যেতে পারিনি,ঘুরে বেড়াচ্ছি মাটির কাছাকাছিই।কোন বন্ধন নেই কোথাও,তবু একটা অনুচ্চারিত টান অনুভব করতে পারছি ঐ পড়ে থাকা শরীরটার জন্য। অনুভুতি! কিন্তু,আমার এই অনুভুতির অস্তিত্ব এল কোথা থেকে! এখন তো আমি হাওয়ার মত স্বচ্ছ,তাতে অনুভুতির স্থান কোথায়! এ নিশ্চয়ই আমার মনের ভুল। মন! সেটাই বা এখন কিভাবে থাকতে পারে আমার জীবনে! জীবন! কোথায়! ভাবনাগুলো সব তালগোল পাকিয়ে গেল কোথাও একটা।তবু,শরীরটা ছুঁতে ইচ্ছে করল,কিন্তু পারলাম না।অথবা,হয়ত পারলাম,কিন্তু কোন স্পর্শ উপলব্ধি হল না। ঘরটা জুড়ে লোকে লোকারণ্য। ঐ তো আমার ছেলে বাবাই,আমার শরীরটায় মুখ গুঁজে কেঁদে চলেছে অনবরত,পায়ের কাছটায় মাথা নিচু করে বসে রয়েছে অমিত,স্পর্শ করে আছে আমার শরীর। কিন্তু,আশ্চর্য! ঐ মানুষগুলোর জন্য একবিন্দু সহানুভুতি নেই আমার বায়বীয় অস্তিত্বের কোন খাঁজে। অথচ,কয়েক মুহূর্ত আগেই এই মানুষগুলোই ছিল আমার জীবিত অবস্থান একমাত্র অবলম্বন।ঐ যে শরীর,ঐ আঁধারে অবস্থানের মুহূর্ত পর্যন্তই ছিল ওরা আমার সাথে,এখন আমি একা,বাস্তবিকই একা।পার্থিব যতটুকু মায়া তা ঐ শরীরের পুড়ে যাওয়ার সাথে সাথেই কাটিয়ে উঠতে পারব। হঠাৎ একটা শোরগোল, জানলা দিয়ে বেড়িয়ে দেখলাম একটা শববাহী গাড়ি এসে দাঁড়াল বাড়ির গেটের সামনে। একদল মানুষ,কিছু পরিচিত কিছু অপরিচিত,ঐ পড়ে থাকা দেহটাকে তুলে নিয়ে যেতে এগিয়ে এল। অমিত সরে দাঁড়িয়েছে একপাশে,কিন্তু,বাবাই কিছুতেই ছাড়তে চাইছে না শরীরটা,শক্ত করে জাপটে ধরে রয়েছে যেন ঐ শরীরটাই ওর মা। অদ্ভুত ব্যাপার,আমার কষ্ট হল না একটুও,বরং একটু হাসিই পেল,ওরা ভাবছে ঐ শরীরটাই আমি,অথচ আমি তো এখন সম্পূর্ণ সতন্ত্র।ওরা সেটা বোঝে না।মৃত্যুর আগে আমিও কি ছাই বুঝতাম! কত প্রিয়জনের মৃত্যুতে আমিও তো বাবাইয়ের মতই করেছি একসময়।অবশেষে ঐ মানুষের দল সফল হল শরীরটা বের করে শববাহী গাড়িতে তুলতে।ধূপ-চন্দন-ফুল-মালা পরিবৃত হয়ে রয়েছে শরীরটা,বেশ একটা পূজো পূজো ব্যাপার।কিন্তু,বুঝতে পারলাম আমার ঘ্রাণশক্তিও আর নেই এখন,কোন কিছুর গন্ধই আর আমি পাই না। গাড়ি ছেড়ে দিল একসময়,আমি আমার অস্তিত্বকে ভাসিয়ে দিলাম কাঁচের ঘরের চারিপাশে,ভিতরে আমার শরীর, বাইরে আমি।পৌঁছে গেলাম শ্মশানযাত্রার অন্তিমলগ্নে, যাত্রা শেষ হল,দেহটা নামিয়ে আনা হল শ্মশানচত্বরে। আমি ভেসে বেড়াচ্ছি এধার ওধার। আমার মৃতদেহ ঘিরে তখন কি বিরাট আয়োজন! জীবিত অবস্থায় আমি কখনোই মৃত্যু নিয়ে এসব আড়ম্বর পছন্দ করতাম না। এখন আমি সমস্ত পছন্দ অপছন্দের ঊর্ধে। তাই ভাবনায় এল না এতকিছু।আমার মুক্তির শেষ সীমানা আসন্নপ্রায়। ইলেকট্রিক চুল্লিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হল আমার দেহ, আমিও ঢুকে পড়লাম হাওয়ার সাথে মিলেমিশে।পুড়ছে দেহ,আমিও মুক্ত হচ্ছি ক্রমশ,আরও মুক্তি,আরও আরও! পুড়তে পুড়তে একসময় ছাই হয়ে গেল আমার আঁধার,এবার আমি সম্পূর্ণ মুক্ত। কি আনন্দ,কি অপার আনন্দ!আনন্দে আমি ভেসে বেড়াচ্ছি চারিধার।আমার বিগত জীবনের মানুষজন বেড়িয়ে যাচ্ছে শ্মশান ছেড়ে,বাবাই তো কেঁদে ভাসাচ্ছে এখনো।আমি ওঁদের সাথে চলার কোন তাগিদ অনুভব করলাম না, বরং এখন আমার উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে বায়ুস্তর পেরিয়ে, অসীমে। চেনা মানুষগুলোকে ফেলে, শ্মশানচত্বর ছাড়িয়ে আমি ভেসে চললাম, ট্রপোস্ফিয়ার ছাড়িয়ে, স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার ছাড়িয়ে, ওজোনস্ফিয়ার-আয়োনোস্ফিয়ার অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছি আমি। কি অসম্ভব দ্রুতগতি আমার! এ কি আলোর গতিবেগ,না কি তার চেয়েও বেশি! কয়েক মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীর বায়ুস্তর ভেদ করে পৌঁছে গেলাম মহাশূণ্যে। মহাশূণ্যে নিজেকে আবিষ্কার করলাম শূণ্য অঙ্কে। এই শূণ্য থেকেই একদিন পৌঁছে গিয়েছিলাম পৃথিবীর কোন এক মাতৃগহ্বরে, মধ্যিখানে এত টানাপোড়েন, জীবনের হিসাবনিকাশ, মৃত্যুর পরেও আবার সেই শূণ্য। শূণ্যতে শুরু, শূণ্যতেই শেষ। হিসাব তো এত সহজ। তবে কেন এই পার্থিব জটিলতা! এসব বোঝার শক্তি আমার নেই, আছে শুধু একটা অনুভুতি, আর সেই অনুভুতির পুরোটাই ঘিরে রয়েছে শুধু অসীম আনন্দ,মুক্তির আনন্দ,শূণ্যতার আনন্দ। মহাশূণ্যে ছুটতে ছুটতে ক্রমশ আমার সমস্ত অনুভুতি যেন মিশে যাচ্ছে চারিধারে,ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসছে আমার অস্তিত্ব। বায়বীয় পিন্ড থেকে বাতাস নিষ্ক্রমণের সাথে সাথে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে পড়ছি আমি,মিলিয়ে যাচ্ছি অসীমে। আরও ক্ষুদ্রতর, আরও আরও। ক্রমে মেলাতে মেলাতে সম্পূর্ণরূপে মিলিয়ে গেলাম আমি, ক্ষুদ্রতম আমার শেষ কণাটুকুও হারিয়ে গেল মহাজাগতিক অসীমতায়, ‘আমি’র অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেল মহাশূণ্যের গহ্বরে। আমি নিঃশেষিত,আমি সমাপ্ত। ‘মা,ও মা,কি গো? কি হয়েছে তোমার! উঠছ না কেন?’-ক্ষীণ আওয়াজটা কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে। আরও একটু জোরে,একসময়ে কানের মধ্যে দিয়ে মাথায় গিয়ে ধাক্কা মারল সপাটে। ধরমর করে উঠে বসলাম আমি,শরীরসুদ্ধু আমি! তাকিয়ে দেখলাম,সামনে বাবাই দাঁড়িয়ে রয়েছে,বাবাইয়ের গলার আওয়াজে অমিতও দৌঁড়ে এসেছে খবরের কাগজ হাতে, গলায় আতঙ্ক –‘শরীর খারাপ করছে নাকি তোমার!’ একটু ধাতস্থ হয়ে আবিষ্কার করলাম, আমি বেঁচে আছি শরীরসুদ্ধু! কি আশ্চর্য! তবে এতক্ষণ কি ঘটে চলেছিল আমার সাথে! স্বপ্ন! নাকি শূণ্য পরিমাপের সহজ খেলাটা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেল কোন মহাজাগতিক শক্তি, যার অস্তিত্ব আজও অধরা আমাদের কাছে!
This website was created for free with Own-Free-Website.com. Would you also like to have your own website?
Sign up for free